আমার শৈশবস্মৃতি রচনা লিখন
সময়ের প্রবহমানতায় মানুষ নিয়তই সম্মুখের পথযাত্রী। এ সম্মুখ যাত্রায় আজ আগামীকালে গিয়ে অতীত হয়ে যায়। কিন্তু কিছু কিছু ঘটনা সময়ের কাছে কখনাে হার মানে না, বরং সময়কে হার মানিয়ে সে ঘটনাগুলাে স্মৃতি হয়ে আজীবন তার উজ্জ্বল উপস্থিতি ঘােষণা করে । শৈশবের স্মৃতিও ঠিক তেমনি, কালের ধারায় কর্মব্যস্ত মানুষ তার শৈশবকে পেছনে ফেলে আসলেও মনের গহীনে তাকে ধারণ করে সারাজীবন।
মানবজীবনের সবচেয়ে আনন্দঘন মুহূর্ত কাটে তার শৈশবে, বাধনহারা মানবশিশু মনের কথা মেনেই শৈশবে তার দিন কাটায় । কোনাে বাধা-নিষেধ, অন্যায়, অসুন্দর তাকে স্পর্শ করতে পারে না, তাই আনন্দ লাভ আর আনন্দদানই এ সময়ে তার একমাত্র কাজ। একজন শিশু কখনাে দুঃখ নিয়ে চিন্তা করে না, সে কেবলই বসন্তের কোকিলের মতাে আনন্দের সুরই বাজায়, আর এ সময়ের আনন্দময় স্মৃতিগুলাে মানব মনে অঙ্কিত হয় চিরকালের আবেদন নিয়ে।
আমার শৈশব কেটেছে চট্টগ্রাম জেলার ছােট্ট একটি গ্রাম- মহাদেবপুরে। এ গ্রামের আলাে, বাতাস, পাখির গান সবই অসাধারণ সৌন্দর্যে মুগ্ধ করত আমাকে মুগ্ধ মন নিয়ে দস্যিপনা করেছি সারা গ্রামজুড়ে। জীবনের শ্রেষ্ঠ সুখময় দিনগুলাে কেটেছে এখানে, আজ যখন শৈশবের দিনগুলাে নিয়ে ভাবি তখন কত না বিচিত্র স্মৃতি মনের পাতায় ভেসে ওঠে। আনন্দপূর্ণ সে দিনকে ফিরে পাওয়ার জন্যে মন ব্যাকুল হয় । ইচ্ছে হয় আবার শৈশবে ফিরে যেতে।
আয়তনে আমাদের বাড়িটি মােটামুটি বড় ছিল । তিনদিকে তিনটি বড় বড় ঘর ছিল, একটা আমাদের, একটা মেজ চাচার,আরেকটা বড় চাচার, মধ্যখানে অনেক বড় উঠোন। একপাশে ছিল বিশাল একটা পুকুর আর বাড়ির চারপাশে নানান প্রজাতির গাছের বাগান। বাড়িতে ঢােকার মুখে ছিল ফুলের বাগান। আজ চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই বাগানে শিশিরভেজা ঘাসের ওপর থেকে শিউলি ফুল কুড়ানাের দৃশ্য। সব চাচাতাে ভাইবােনরা মিলে উঠোনজুড়ে খেলেছি কখনাে বউচি, কখনাে কানামাছি, মাতিয়ে রেখেছি সারাবাড়ি। চাঁদনি রাতে উঠোনে পাটি বিছিয়ে সবাই মিলে বসত গল্পের অসির। দাদি ছিলেন এ আসরের মধ্যমণি, সব নাতি-নাতনিকে চারপাশে বসিয়ে একের পর এক বলে যেতেন রাজা-রানির গল্প, রাজকন্যার গল্প,
রাক্ষসের গল্প । কখনাে বলতেন ভূত-প্রেতের গল্প ।
মনে পড়ে দাদি একবার ভূতের গল্প বলেছিলেন বলে আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম । ভয়ে সে রাতে ঘুম হয়নি। দু দিন জ্বরে ভুগেছিলাম। আমার মাথায় হাত রেখে দাদি খুব কেঁদেছিলেন। আর কখনাে তিনি ভূতের গল্প শােনাননি। এ ঘটনার তিন বছর পর দাদি মারা যান। শিশুহৃদয় দুঃখ বহন করে না, কিন্তু দাদিকে হারানাের ব্যথা এখনাে আমায় কষ্ট দেয়। কেননা তিনি ছিলেন আমাদের পরম বন্ধু। অনেক দস্যিপনা করেও দাদির সহায়তায় আমরা বাবা-মায়ের বকুনি থেকে পার পেয়ে যেতাম।
এ একটা দুঃখময় ঘটনা ছাড়া শৈশবে আর সব স্মৃতিই আমার জন্যে আনন্দের । চাচাতাে ভাইবােনের সংখ্যা আটজন হলেও আমার সব দুষ্টুমির সহচরী ছিল আমার সমবয়সি চাচাতাে বােন। গ্রীষ্মের দুপুরে মা যখন আমাদের ঘুমানাের জন্যে বাধ্য করতেন, আমরা তখন সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে গিয়ে উঠতাম আম গাছের মগডালে। পাকা আমগুলাে পাড়ার লােভ আমাদের কিছুতেই বিছানায় থাকতে দিত না। কতদিন এ কাজের জন্যে মার কাছে বকুনি খেয়েছি। কিন্তু আমাদের চেহারা, চোখের চাহনি দেখে মা হেসে ফেলতেন। আজ সে বকুনি খাওয়ার জন্যে মন অস্থির হয়ে থাকে। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠে না। শৈশবের অনেক স্মৃতি আছে স্কুলকে কেন্দ্র করে। মনে পড়ে প্রথমদিন স্কুলে যাওয়ার কথা। অন্য ভাইবােনেরা সাথে থাকলেও প্রথমদিন বাবা সাথে গিয়েছিলেন । খুব আনন্দ আমার। গােল বাধল তখন যখন বাবা আমাকে ক্লাসরুমে বসিয়ে দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছিলেন। সে মুহর্তে আমার কান্না দেখে কে! সব শিক্ষক সেখানে এসে জড়াে হয়ে গেলেন, অনেক আদর করলেন, কিন্তু আমার কান্না থামাতে পারলেন না। অগত্যা বাবা আমাকে সাথে করেই বাড়ি ফিরলেন । আজ সে কথা মনে পড়লে হাসি পায় ।
যখন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি, তখন আমাদের স্কুলে অনেক আয়ােজন করে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়েছিল। স্মৃতিরক্ষা এবং একশ মিটার দৌড় প্রতিযােগিতায় আমি প্রথম হলাম, কিন্তু অঘটনটা ঘটল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সময়। আমরা একটা
হাসির নাটকে অংশ নিয়েছিলাম, আমার চরিত্রটা ছিল প্রধান শিক্ষিকার। সুতরাং, আমাকে শাড়ি পরতে হবে, শাড়ি পরানাে হলাে, কিন্তু হাঁটাটা আমার জন্যে দুঃসাধ্য হয়ে পড়ল। কিছুতেই সামাল দিতে পারছিলাম না। ব্যস, মঞ্চে উঠতে গিয়েই মঞ্চের বাইরে সিঁড়িতেই আমি চিৎপটাং। এতগুলাে মানুষের সামনে পড়ে লজ্জায় আমার চোখ দিয়ে পানি এসে গেল। আর অন্য ছাত্রছাত্রীরা দাঁত বের করে হাসছে। আমার ভীষণ রাগ হয়েছিল, কিন্তু আজ সেকথা ভাবলে আমার নিজেরই হাসি পায়।
আমাদের বাড়ির পাশেই ঢাকা-চট্টগ্রাম ট্রাঙ্ক রােড, আমাদের ভাইবােনদের শখ ছিল গাড়ির সংখ্যা গােনা। কিন্তু কিছুতেই। পেরে উঠতাম না। না পারার ব্যর্থতায় কষ্ট পেতাম খুব। ভাবতাম, আরেকটু বড় হয়ে নিই, ঠিকই পারব । এখন বড় হয়েছি কিন্তু সে কাজ আজও পারা যায়নি। কিন্তু সারি বেঁধে গাড়ি গণনার যে স্মৃতি মনের পর্দায় ভেসে ওঠে, তা আমার শিশুমনের নির্মলতার কথা মনে করিয়ে দিয়ে আবেগি করে তােলে।
শৈশবের স্মৃতিতে আরেকটা মুখ ভেসে ওঠে প্রতিনিয়ত। তিনি হলেন আমার একমাত্র মামা । আমাদের বাড়িতে আসার সময়। তিনি অনেক মজার মজার ছড়ার বই, গল্পের বই আনতেন। দল বেঁধে আমরা সবাই মামার সাথে ঘুরে বেড়াতাম। কখনাে পুরাে গ্রাম ঘুরে বেড়াতাম, আবার কখনাে যেতাম একটু দূরে রেললাইনের পাড়ে । রেলগাড়ি যাওয়ার সময় আমরা সবাই একসাথে চিৎকার করে বলতাম ঝিকঝিক ঝিকঝিক। রেলের শব্দের সাথে মিলে যেত বলে খুব আনন্দ পেতাম । রেললাইন থেকে পাথর কুড়ানােতেই ছিল আমার আসল আনন্দ। কাজের সূত্রে মামা এখন দেশের বাইরে, কিন্তু তার সাথে আমার শৈশবের যে স্মৃতি তা এখনাে অম্লান।
সময়ের আবর্তনে দিনের প্রহর ভাগের মতােই জীবনের প্রহরও ভাগ হয়। দিনের ক্ষেত্রে যেমন পালাক্রমে সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা-রাত আসে; জীবনের ক্ষেত্রেও তেমনি আসে শৈশব-কৈশাের-যৌবন-বার্ধক্য। কিন্তু দিনের সূচনায় যেমন ভােরের মিষ্টি আলাের আবেদন অম্লান, তেমনি জীবনের যে পর্যায়েই মানুষ থাকুক না কেন শৈশবের স্মৃতি থাকে চির অম্লান।
বর্তমানকে নিয়ে মানুষ যতই ব্যস্ত থাকুক না কেন, বর্তমানের আড়ালে অতীত সবসময় সগর্বে বিরাজ করে । পিছনে ফেলে আসা সময় স্মৃতি হয়ে মানুষের অন্তরে আসন নেয় । কবিগুরুর ভাষায়–
‘বাহির হতে ভিতরেতে আপনি লহাে আসন পেতে
তােমার বাশি বাজাও আমি আমার প্রাণের অন্তঃপুরে।’
আমার শৈশবের আনন্দঘন মুহুর্তের সঙ্গীরা আজ সবাই কর্মব্যস্ত জীবন গড়ার তাগিদে সবাই আজ বিচ্ছিন্ন। কেউ কেউ বিদায় নিয়েছেন চিরদিনের জন্যে । কিছুই আর আগের মতাে নেই। তবুও শৈশবকে ফিরে পাওয়ার ইচ্ছে হয় খুব। যদিও জানি শৈশবে ফিরে যাওয়া বা শৈশবকে ফিরে পাওয়া অসম্ভব। শুধুমাত্র স্মৃতিতেই শৈশবকে ধারণ করে আছি মনের গহিনে। ব্যস্ত জীবনের মধ্যে শৈশবের নিষ্কণ্টক স্মৃতিগুলাে আজও আমার মনে সােনালি স্বপ্নের মতাে ভাসে।