প্রয়ােজনে যে মরিতে প্রস্তুত, বাঁচিবার অধিকার শুধু তাহারই ভাবসম্প্রসারণ
মূলভাব: যথার্থ জীবনের ধর্ম দুঃসাহসী চিত্ত, দৃঢ় মনােবল আর কঠিন আত্মপ্রত্যয়। যারা এসব গুণের অধিকারী তাদের বেঁচে থাকা সার্থক ও যথার্থ। কেননা মরণকে তাঁরা তুচ্ছজ্ঞান করে যেকোনাে প্রয়ােজনে জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত থাকেন। আর যারা ভীরু ও কাপুরুষ তারা সদা পলায়নপর। তারা বেঁচে থেকেও যেন মৃত। পৃথিবীর অমােঘ নিয়মে সব মানুষকেই একদিন না একদিন মৃত্যুকে বরণ করে নিতে হয়। মৃত্যু নিষ্ঠুর বাস্তব হলেও এর থেকে কারাে নিস্কৃতি নেই।
ভাবসম্প্রসারণ: মৃত্যু জীবনের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। ‘মরিতে না হইলে বাঁচিয়া থাকিবার কোনাে মর্যাদাই থাকিত না।’ জীবনকে সত্যিকারভাবে সফল ও উপভােগ্য করতে হলে মৃত্যুভয় পরিহার করতে হবে। কর্মময় মানবজীবনের প্রতিটি কাজেই কম-বেশি ঝুঁকি আছে। যে কাজ যত দুরূহ, যত বিপজ্জনক সে কাজে মৃত্যুর ঝুঁকি তত বেশি। এমন ক্ষেত্রে দৃঢ়চিত্ত সাহসীরাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কর্ম সম্পাদনে পিছপা হন না। তাই এ অনিবার্যকে সহজভাবে মেনে নেওয়া উচিত। তা না হলে জীবনকে সুন্দরভাবে উপভােগ করা যায় না। জীবনে চলার পথে, প্রতিটি কাজে নানা ধরনের ঝুঁকি থাকে। যাঁরা দৃঢ়চিত্ত, সাহসী তারা বিপদের পরােয়া করেন। মৃত্যুকে সহজভাবে মেনে নিয়ে অনেক বিপজ্জনক ও কঠিন কাজ করেন স্বচ্ছন্দে। অদম্য সাহস ও দৃঢ়চিত্তের অধিকারী। যাঁরা দেশ ও জাতির যেকোনাে প্রয়ােজনে ঝাপিয়ে পড়েন। পায়ে পায়ে মৃত্যুর সম্ভাবনা মেনে নিয়েই দুর্যোগের সময় জীবন বাজি রেখে দুর্যোগের মােকাবিলা করেন। অগ্নিকাণ্ড হলে আটকে পড়া জানমাল উদ্ধারে, ঝড়ঝঞ্ঝা, বন্যায় বিপন্ন মানুষকে বাঁচাতে এমনি নানা দুর্যোগ ও দুর্ঘটনায় দৃঢ়চিত্তের লােকেরাই এগিয়ে আসেন, বাড়িয়ে দেন সাহায্যের হাত। শত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে বাঁচাতে সাহসী লােকেরাই ঝাপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে লাখাে শহিদের জীবনের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। এমন জীবনের অধিকারী যারা তারা মৃত্যুর পরও অমরত্ব লাভ করেন। সাহসী। লােকেরা প্রতি মুহূর্তে জীবনকে, পৃথিবীর সৌন্দর্যকে উপভােগ করেন। উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিতে, মহাশূন্যে বিচরণে, দুর্গম পাহাড় আরােহণে প্রতি মুহূর্তে বিপদের আশঙ্কা জেনেও ভয়ংকর সুন্দরের নেশা তাদের দুর্দমনীয় করে তােলেন। বিজ্ঞানের নিত্যনতুন প্রতিটি আবিষ্কারের পেছনেও রয়েছে নানারকম ঝুঁকি। তাই সমাজ ও সভ্যতা বিকাশের প্রতিটি ধারায় রয়েছে। সাহসী মানুষের মহান অবদান। আর যারা ভীরু তারা বরাবর মৃত্যুকে এড়িয়ে যেতে চায়। কাপুরুষ চিত্ত তাদের গৃহকোণে আবদ্ধ করে রাখে। পৃথিবীর অপার সৌন্দর্য আর আনন্দ উপভােগ থেকে তারা বঞ্চিত হয়, বঞ্চিত হয় জীবনের প্রয়ােজনে জীবন বিলিয়ে দেওয়ার অপার সুখ থেকে। তাই তাদের বেঁচে থাকা অর্থহীন। প্রয়ােজনে যারা মরতে দ্বিধা করেন না, তাদের বেঁচে থাকাই সার্থক।
একই ভাবসম্প্রসারণের ভিন্ন প্রতিলিপন
মূলভাব : ন্যায় ও সত্যের জন্য যারা হাসিমুখে জীবন উৎসর্গ করেন, তারাই প্রকৃতপক্ষে অমরত্ব লাভের অধিকারী।
সম্প্রসারিত ভাব : মৃত্যু অনিবার্য সত্য। তারপরও বেঁচে থাকার জন্য মানুষের রয়েছে চিরন্তন আগ্রহ। মৃত্যু ভয়ে ভীত ব্যক্তি কাপুরুষ এবং নিন্দাহ। মৃত্যুই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে। এমন ভাবনা থেকেই আধুনিক কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছেন, “মৃত্যুর পরও মানুষ বেঁচে থাকে।” এ বেঁচে থাকাই যথার্থ বাচা, মন ভরে বাচা। মৃত্যুকে এড়িয়ে চললে, মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচা যায় না। সম্মানের সঙ্গে আমরা যদি তার কাছে মাথা নত করি তাহলেই মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আমরা মৃত্যুঞ্জয়ী হতে পারব। যে যথার্থ মানুষ, সে মৃত্যুকে বন্ধু ভেবে জীবনকে সার্থকতায় ভরে তুলতে চায়। জীবনের প্রয়ােজনে মৃত্যু অপরিহার্য। তাই বাচার প্রয়ােজনে মৃত্যুকে হাসিমুখে বরণ করা মানুষের অবশ্য কর্তব্য। ফ্রাঙ্কলিনের কথায়, “মানুষ না মরা পর্যন্ত পরিপূর্ণভাবে জন্মলাভ করে না।” পৃথিবীতে যে সব মহামানব স্বীয় কর্মের দ্বারা প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে আছেন, তারা সবাই মৃত্যুর মধ্য দিয়ে অমর আসনে সকল মানুষের অন্তরে ঠাই করে নিয়েছেন। মৃত্যু মহান। তাই মৃত্যুর জন্য তৈরি ব্যক্তিই যথার্থভাবে বাঁচার অধিকারী। কবির কথায়-
“মৃত্যুকে যে এড়িয়ে চলে মৃত্যু তারেই টানে
মৃত্যু যারা বুক পেতে লয় বাঁচতে তারাই জানে।”
মন্তব্য : পৃথিবীতে যারা ন্যায় ও সত্যের জন্য হাসিমুখে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন, তারা আজও আমাদের মাঝে স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে রয়েছেন। তাই ন্যায় ও সত্যের পথে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত ব্যক্তিই যথাযথভাবে বাঁচার অধিকারী।