Table of Contents
রচনা: রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন / মহীয়সী নারী
রােকেয়া সাখাওয়াত হােসেন রচনার সংকেত
- ভূমিকা
- জন্ম ও বংশ পরিচয়
- রােকেয়ার বাল্যজীবন ও পারিবারিক আবহ
- রােকেয়ার শিক্ষালাভ
- রােকেয়ার শিক্ষা ও সমাজভাবনা
- রােকেয়ার স্বদেশপ্রেম
- রােকেয়ার সাহিত্য সাধনা
- নারী জাগরণের পথিকৃৎ রােকেয়া
- উপসংহার
রােকেয়া সাখাওয়াত হােসেন রচনা লিখন
ভূমিকা:
বাংলাদেশের মুসলিম সমাজে নারীমুক্তি আন্দোলনের পথিকৃৎ রােকেয়া সাখাওয়াত হােসেন। সময় ও যুগপরিবেশের তুলনায় অগ্রগামী ছিলেন তিনি। ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশের পশ্চাৎপদ সমাজে মেয়েদের বঞ্ছনা ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে তিনি সােচ্চার কণ্ঠে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। নতুন চিন্তা, কৌতূহল, অনুসন্ধিৎসা ও যুক্তিপ্রিয়তা প্রভৃতির মাধ্যমে মানবিক মূল্যবােধের বাণীই তিনি প্রচার করেছেন। তাঁর স্বল্পকালীন জীবনের ব্রতই ছিল নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা, সমাজপ্রগতি সৃষ্টি এবং মাতৃভাষা বাংলার গৌরব প্রতিষ্ঠা। তাই বাংলাদেশের সমাজবিপ্লবের ইতিহাসে এ মহীয়সী নারীর নাম গভীরভাবে জড়িত।
জন্ম ও বংশ পরিচয়:
রােকেয়া সাখাওয়াত হােসেন ১৮৮০ সালের ৯ই ডিসেম্বর রংপুর জেলার মিঠাপুকুর থানার পায়রাক গ্রামে এক ক্ষয়িষ্ণু জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। রােকেয়ার বাবার নাম ছিল মৌলভি জরিউদ্দীন মােহাম্মদ আবু আঙ্গী সাবের এবং মা ছিলেন রাহাতুন্নেসা। ছয় ভাইবােনের মধ্যে রােকেয়া ছিলেন চতুর্থ সন্তান। তাঁর পূর্বপুরুষ বাবর আলী আর বাবর তাব্রিজি ছিলেন একজন বহিরাগত মুসলমান। তিনি ভাগ্যান্বেষণে স্বদেশভূমি ইরান ছেড়ে ভারতে আসেন। রােকেয়া পূর্বপুরুষরা মুঘল সরকারের আমলে এবং ইংরেজ আমলে উচ্চপদে নিয়ােজিত ছিলেন। রােকেয়ার পিতৃপরিবার অর্থ পায়রাবন্দের বিখ্যাত সাবের পরিবার বিশাল জমিদারি ও রাজকীয় অনুগ্রহের অধিকারী ছিল। রােকেয়া ছিলেন এ পরিবারের অষ্টম উত্তর পুরুষ, রােকেয়ার জন্মলগ্নে তার পরিবার পূর্বপুরুষের বিলাসিতা ও অমিতাচারের ফলে করুণ পরিণতির শিকার হয় আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত ছিল।
রােকেয়ার বাল্যজীবন ও পারিবারিক আবহ:
রােকেয়া ছিলেন এক ক্ষয়িষ্ণু বনেদি সামন্ত পরিবারের অংশ । ফলে বাংলাদেশের সমসাময়িক অন্যান্য বনেদি মুসলমান পরিবারের মতাে এ পরিবারের মানসিকতাও ছিল রক্ষণশীল । বিদ্যানুরাগ ও জ্ঞান- পিপাসার প্রতি তাঁর পিতার গভীর আগ্রহ থাকলেও তার মন কুসংস্কার ও গোঁড়ামিমুক্ত ছিল না। ফলে অন্যান্য মুসলিম পরিবারের মতাে এ পরিবারেও নারীরা ছিল সকল অর্থেই অন্তঃপুরিকা, অবরােধবাসিনী । পুরুষশাসিত পারিবারিক ও সামাজিক আবহে নারীর স্বাভাবিক বিকাশ ছিল অবহেলিত। এ আবহেই কেটেছে রােকেয়ার বাল্যজীবন। তৎকালীন মুসলিম পরিবারগুলােতে পর্দাপ্রথার নির্মমতা ছিল অবর্ণনীয়। পর্দার নির্মমতায় মেয়েদের স্বাধীন চলাফেরা ছিল নিষিদ্ধ। এ পারিবারিক মণ্ডলেই রােকেয়ার বাল্যজীবন ও কৈশাের কেটেছে।
রােকেয়ার শিক্ষালাভ:
রােকেয়ার পিতা নিজে বিদ্যোৎসাহী এবং ছেলেদের উচ্চশিক্ষিত করার ব্যাপারে আগ্রহী হলেও মেয়েদের লেখাপড়া শেখানাের জন্যে বলিষ্ঠ কোনাে ভূমিকা রাখেননি। পারিবারিক ঐতিহ্য অনুযায়ী কেবল কোরআন পাঠের মধ্যেই মেয়েদের শিক্ষা আবদ্ধ ছিল। বাংলা শিক্ষার ব্যাপারে ছিল চরম অনাগ্রহ। পরিবারের নিয়মানুযায়ী রােকেয়ার শিক্ষাগ্রহণ এসব ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ ছিল । কিন্তু লেখাপড়ার বিষয়ে তাঁর ছিল চরম আগ্রহ। এক্ষেত্রে তিনি বড় বােন করিমুন্নেসার এবং বড় ভাই ইব্রাহিম সাবেরের সহযােগিতায় বাংলা ও ইংরেজি শিক্ষা লাভ করেন। পরবর্তীকালে তিনি স্বামী সৈয়দ সাখাওয়াত হােসেনের আনুকূল্য ও প্রেরণায় ইংরেজি শিক্ষায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন। এমনকি ইংরেজিতে সাখাওয়াতের সরকারি কাজেও তিনি অনেক সাহায্য করতেন। পিতৃপরিবারে শিক্ষালাভের ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হলেও স্বামীর উদার দৃষ্টিভঙ্গির ফলে বিয়ের পরে রােকেয়ার বিদ্যাচর্চা পরিপূর্ণতা পায়।
রােকেয়ার শিক্ষা ও সমাজভাবনা:
বাঙালি মুসলমান সমাজে রােকেয়াই সর্বপ্রথম শিক্ষা বিস্তারকে নারীমুক্তি ও প্রগতির বৃহত্তর অভিযাত্রার সাথে যুক্ত করেন। তার সমাজভাবনা মূলত নারীমুক্তি ভাবনাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। বাঙালি মুসলিম সমাজে। নারীর প্রতি যে নিষ্ঠুরতা ও অবিচার তারই বিরুদ্ধে ছিল রােকেয়ার আপসহীন সংগ্রাম। আর এ সামাজিক উৎপাত থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় হিসেবে তিনি শিক্ষাকেই ভেবেছিলেন প্রধান মাধ্যম। এ প্রসঙ্গে তাঁর মত হলাে, “শিক্ষা বিস্তারই এইসব অত্যাচার নিবারণের একমাত্র মহৌষধ। শিক্ষা বলতে তিনি এমন শিক্ষাকে বুঝিয়েছেন, যা নারীদের মধ্যে তাদের আপন অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা, আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদাবােধ জাগাবে। নারীসমাজের মুক্তির জন্যে এ ধরনের শিক্ষা ভাবনা থেকেই তিনি ‘সাখাওয়াত মেমােরিয়াল স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন। রােকেয়ার সমাজভাবনার কেন্দ্রে ছিল নারীর অধিকারবােধ প্রতিষ্ঠা করা। এসব ক্ষেত্রে তাঁর কিছু ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গি বর্তমানেও যথেষ্ট সমকালীন পুরুষশাসিত সমাজে নারীর সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি প্রধান উপায় ভেবেছেন অর্থনৈতিক মুক্তি বা স্বাবলম্বনকে। সমাজপ্রগতির ক্ষেত্রে এ ধরনের চিন্তা সমসাময়িককালে সাহসিকতার পরিচয় তুলে ধরে, সমাজপ্রগতির ক্ষেত্রে রােকেয়া ছিলেন যুক্তিবাদ ও মুক্তদৃষ্টির অধিকারী। তাই পুরুষ নারীর শাসক বা প্রভু নয় বরং সহযােগী – এ মতেই তিনি বিশ্বাসী আর এতেই তিনি সমাজের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল। দেখেছেন।
রােকেয়ার স্বদেশপ্রেম:
নারীমুক্তি ও নারীশিক্ষার জন্যে রােকেয়ার আজীবন সংগ্রাম স্বদেশের প্রতি ভালােবাসার অন্যতম প্রধান অঙ্গ। তাঁর অনেক প্রবন্ধে তিনি সাধারণ মানুষের কথা ব্যক্ত করেছেন। মুক্তিফল’ নামক রূপক কাহিনিতে তিনি ভারতবর্ষের পরাধীন অবস্থার অবমাননার চিত্র এবং জন্মভূমির দীনতা দূর করার যে উপায় বলেছেন তা তাঁর গভীর দেশপ্রেমের নিদর্শন। তবে তিনি অরাজনৈতিক তৎপরতার চেয়ে অবরুদ্ধ সমাজব্যবস্থার পরিবর্তনের লক্ষ্যে আত্মনিয়ােগকে গুরুত্বপূর্ণ ভেবেছিলেন। তার এ প্রয়াস স্বদেশের প্রতি অকুণ্ঠ ভালােবাসার নির্মল প্রকাশ। স্বদেশের প্রতি এ আকর্ষণই তাকে পরিবারের অলীক আভিজাত্যের মুখােশ ত্যাগ করে তাঁর প্রাণের ভাষা বাংলাকে গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেছিল। শিক্ষার মাধ্যম হিসেবেও তিনি মাতৃভাষার প্রয়ােজনীয়তা উপলব্ধি করেছেন। পৌরাণিক মনে স্ত্রী বিদ্বেষ’ প্রবন্ধে তিনি এ বিষয়ে বৈজ্ঞানিক ও যুক্তিবাদী মনােভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন।
রােকেয়ার সাহিত্য সাধনা:
সমাজসংস্কার, শিক্ষা বিস্তার তথা নারীমুক্তির লক্ষ্যে তাঁর বিপুল কর্মপ্রচেষ্টার অন্যতম বহিঃপ্রকাশ ছিল তাঁর সাহিত্য সাধনা। পরিবারের কঠোর নিয়মতান্ত্রিক পরিবেশে নারী জীবনের যে অভিজ্ঞতা এবং পাশ্চাত্য সাহিত্য পাঠে নারীমুক্তি ও সমঅধিকারের যে চেতনা তিনি পেয়েছিলেন তাই তাঁর সাহিত্যের পটভূমিকা তৈরি করেছিল। তাঁর রচনাগুলােতে শিক্ষা ও সমাজবিষয়ক ভাবনা, দূরদৃষ্টি, যুক্তিবাদ ও অসাম্প্রদায়িক মানসিকতার পরিচয় সুস্পষ্ট। সমাজের কল্যাণ সাধনই তাঁর সাহিত্য সাধনার মূল লক্ষ্য। বিশেষ করে তার প্রবন্ধগুলােতেই তাঁর সুপরিশীলিত ও সুচিন্তিত মতের স্পষ্ট প্রকাশ ঘটেছে। এর মধ্যে স্ত্রী জাতির অবনতি’, ‘অর্ধাঙ্গী’, ‘নিরীহ বাঙালি’, ‘বােরকা প্রভৃতি প্রবন্ধ উল্লেখযােগ্য। তার রূপকথাগুলােও দৃষ্টিভঙ্গি ও সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে তাঁর মনােভাবের চমত্তার বহিঃপ্রকাশ। অল্প কয়েকটি রচনা বাদ দিলে রােকেয়ার প্রায় সমস্ত রচনারই চরিত্র কমবেশি সমাজসমালােচনামূলক। দুই খণ্ড ‘মতিচুর’সহ রােকেয়ার মােট গ্রন্থ সংখ্যা ৫ এগুলাে হলাে— মতিচুর (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড), Sultana’s Dream, পদ্মরাগ, অবরােধবাসিনী। লেখিকার সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য হলাে সহজ ও সরস ভাষা এবং তীক্ষ যুক্তি। তবে তার ব্যঙ্গাত্মক রচনাগুলাে অতি সুন্দর ও সার্থক।
নারী জাগরণের পথিকৃৎ রােকেয়া:
প্রতিকূল সময় ও বিরুদ্ধ পরিবেশের সাথে লড়াই শৈশব থেকেই রােকেয়ার ভেতর জন্ম দিয়েছিল একজন আপসহীন সংগ্রামী নারীসত্তার । পুরুষশাসিত সমাজের বিধিনিষেধ তাকে এ চেতনায় উদ্দীপ্ত করে— আত্মনির্ভরতার পথেই নারীজাতির প্রকৃত মুক্তি বা প্রগতি সম্ভব। ভারতবর্ষের শাসনতান্ত্রিক সংস্কারে নারীর অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে রােকেয়া স্পষ্ট ধারণা পােষণ করতেন । তাই তিনি নারীসমাজের শাসনতান্ত্রিক অধিকার বিবাহ ও বিবাহ বিচ্ছেদ,bপিতা ও অভিভাবকের স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তিতে অধিকার, জীবনােপায় অবলম্বনের অধিকার প্রভৃতি বিষয়ে নানাভাবে দাবি উপস্থাপন ও প্রতিষ্ঠা করেছেন। সর্বাত্মক নারীমুক্তির প্রত্যক্ষ সংগ্রামই ছিল রােকেয়ার সংগ্রাম। তবে নারীমুক্তির নামে উগ্রতাকে তিনি কখনােই সমর্থন দেননি। এর প্রকাশ রয়েছে অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধে । তিনি মূলত নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করেছেন। অর্থাৎ সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্যেই সংগ্রাম করেছেন। এ সাম্য তিনি যেমন কামনা করেছেন পরিবারে। তেমনি। ‘সুলতানার স্বপ্ন’, ‘মুক্তিফল’ প্রভৃতি রচনায় সামাজিক ও রাজনৈতিক মুক্তির জন্যে তিনি একান্তভাবে।উল্লেখ করেছেন পুরুষের সঙ্গে নারীর কল্যাণময় ও গুরুত্বপূর্ণ অবদানের কথা। তাই তিনি পুরুষকে নারীর স্বামী নয় বরং অর্ধাঙ্গ’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনিই প্রথম মুসলিম নারী যিনি সমাজ ও দেশের কল্যাণ দেখেছেন নারী-পুরুষের সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে। আর তাই সমকালে তথাকথিত বনেদি মুসলিম পারিবারিক ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে ছিল তার সংগ্রাম।
উপসংহার:
বাঙালি মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রপথিক রােকেয়া সাখাওয়াত হােসেন । প্রকৃত নাম রােকেয়া খাতুন। স্বল্পায়ু। জীবনে তিনি সাহিত্যসাধনা ও বাস্তব কর্মপ্রয়াসের মাধ্যমে বাঙালি নারীর জীবনে সর্বপ্রথম আত্মমর্যাদা ও গৌরবের দীপ্ত মশাল প্রজ্জ্বলিত করে দিয়েছেন। সমাজের কল্যাণ সাধনের লক্ষ্যে তিনি ছিলেন অক্লান্ত কর্মী; অশিক্ষা ও কুসংস্কার তাঁর চেতনাকে সবসময় আঘাত করেছে। তাই এরই বিরুদ্ধে ছিল তাঁর আজীবন সংগ্রাম। ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর এ মহীয়সী নারীর জীবনাবসান ঘটে
2 comments
This is copied from panjere guide
We just collect to provide you at one place.Check disclaimer.