Table of Contents
শ্রমের মর্যাদা রচনার সংকেত
- ভূমিকা
- শ্রমের মহিমা
- শ্রমের গুরুত্ব
- মানসিক ও শারীরিক শ্রম
- ব্যক্তিজীবনে শ্রমের গুরুত্ব
- সভ্যতা বিকাশে শ্রম
- উপসংহার
শ্রমের মর্যাদা রচনা
ভূমিকা:
মানবসভ্যতার সকল সৃষ্টির মূলেই রয়েছে শ্রম । আজকের সভ্যতা যুগ-যুগান্তরের অগণিত মানুষের নিরলস শ্রমের ফসল । জীবনধারণের তাগিদেই মানুষ কর্মব্যস্ত। তাকে শ্রমের মাধ্যমেই তার চাহিদা পূরণ করতে হয়। গুহাবাসী মানুষ একমাত্র শ্রমের মাধ্যমেই বর্তমানের এ উন্নত সভ্যতার জন্ম দিয়েছে। কৃষকের ফসল উৎপাদন, শিল্পীর শিল্পকর্ম, জ্ঞানীর জ্ঞানার্জন, মহাশূন্যে নভােচারীর দুঃসাহসিক অভিযান, সমুদ্রের তলদেশ হতে ডুবুরির দুঃসাহসিক তথ্য আহরণ, বিজ্ঞানীর নব নব অত্যাশ্চর্য আবিষ্কার সবই শ্রমলব্ধ ফসল। মানবজীবনের সবক্ষেত্রেই যা কিছু দৃশ্যমান তা সবই পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে।
শ্রমের মহিমা:
জন্মগতভাবেই মানুষ কিছু না কিছু সুপ্ত প্রতিভার অধিকারী। আর এ সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ একমাত্র শ্রমের মাধ্যমেই সম্ভব। মানুষ নিজেই তার ভাগ্যনির্মাতা। পরিশ্রমের মাধ্যমেই মানুষ নিজের ভাগ্য গড়ে তােলে। ইতিহাসলব্ধ জ্ঞান থেকে আমরা দেখতে পাই, যে সকল মানুষ পৃথিবীতে স্মরণীয়-বরণীয় তাঁদের সাধনাই ছিল পরিশ্রম। তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমের সাফল্যেই মানবসভ্যতা সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর হয়েছে। উন্নত দেশগুলাের দিকে তাকালে দেখা যায়, তাদের উন্নতি
পরিশ্রমেরই অবদান। যে জাতি শ্রমকে মূল্য দিতে পেরেছে, সে জাতিই জগতে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে। কঠোর পরিশ্রমই। তাদের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের মহিমা দিয়েছে।
শ্রমের গুরুত্ব:
মানবজীবন ও মানবসভ্যতার উন্নতির জন্যে প্রতিটি ক্ষেত্রে শ্রম অপরিহার্য উপাদান। মানুষের জন্ম তার নিজের অধীন নয়, কিন্তু কর্ম নিজের অধীন। এজন্যেই বলা হয় “জন্ম হােক যথা তথা কর্ম হােক ভালাে’, কারণ কমই পারে মানুষকে সাফল্যের স্বর্ণশিখরে পৌছে দিতে। শ্রমের মাধ্যমেই মানুষ জীবন সংগ্রামে জয়ী হতে পারে। অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতি মােকাবিলা করে মানুষকে তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হয়। এসব ক্ষেত্রে পরিশ্রমই তার একমাত্র হাতিয়ার। তাই ব্যক্তিজীবনে এবং সমাজে শ্রমের যথাযথ মর্যাদা ও স্বীকৃতি দিতে হবে। সমাজে বিভিন্ন স্তরে শ্রমের পার্থক্য থাকলেও কোনােটার গুরুত্বই কম নয়। সামাজিক প্রয়ােজনীয়তা অনুযায়ী প্রতিটি স্তরের শ্রমই সমান গুরুত্বপূর্ণ। কৃষক, মজুর, শিক্ষক, ডাক্তার, শিল্পী, বিজ্ঞানী, রাষ্ট্রনায়ক প্রত্যেকের যথাযথ পরিশ্রমই সমাজ ও দেশের অগ্রগতি সাধন করে। তাই মানবজীবনে শ্রমের গুরুত্ব অপরিসীম।বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছেন, ‘… a hard working street cleaner is a better man than a lazy scholar.’ শ্রমই মানুষকে সৃজনশীল করে। নব নব সৃজনের মাধ্যমে মানুষ নতুন অগ্রগতি সাধন করে। আজকের দিনের মানুষের শ্রমসাধিত কর্ম আগামী দিনের মানুষকে নতুন কর্মে উজ্জীবিত করে। এককথায়, মানুষকে যথাযথ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত ক্রা এবং কাল থেকে কালান্তরে অমর করে রাখার একমাত্র উপায় শম। শ্রমবিমুখ তথা কর্মবিহীন ব্যক্তি মৃত্যুর সাথে সাথেই পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যায়। অন্যদিকে শ্রমের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মানুষ ইতিহাসের পাতায় বেঁচে থাকে চিরদিন। অর্থাৎ মানুষ বেল। প্রাত্যহিক জীবনযাপনেই বাঁচে না। সশ্রমের শক্তিতেই বাঁচে।
মানসিক ও শারীরিক শ্রম:
সকল কাজের সাফল্য প্রাপ্তির জন্যে মানসিক ও শারীরিক পরিশ্রমের ভূমিকা অনস্বীকার্য। মানসিক পরিশ্রম মানসিক উন্নতি দান করে এবং নবসৃষ্টির, নবচিন্তার জন্ম দেয়। আর মানসিক শ্রম যে কাজের চিন্তা করে শরীরিক শ্রম তা সম্পাদন করে। তাই সকলকেই এ উভয় শ্রমের মর্যাদাকে স্বীকার করতে হবে। জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভের ক্ষেত্রে উভয়। শ্রমই সমান গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কার্যত আমরা দেখি, মানসিক পরিশ্রমের মর্যাদা মানুষ স্বীকার করলেও শারীরিক পরিশ্রমকে অনেকেই অবজ্ঞার চোখে দেখে । ফলে সামাজিক ক্ষেত্রে দেখা যায়, শিক্ষক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ প্রমুখ পেশাজীবী মানুষের অবস্থান সমাজের উপরতলায় । অন্যদিকে কুলি-মজুর-কৃষক-শ্রমিক এদের অবস্থান সমাজের নীচুতলায় । অন্নহীন, বস্ত্রহীন, শিক্ষাহীন মানবেতর জীবনই তাদের নিত্যসঙ্গী। যদিও শারীরিক শ্রম সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভের উপায়, আত্মসম্মানের পরিপন্থি নয়। প্রতিটি মানুষই দেশ ও জাতির কল্যাণ করার উদ্দেশ্যে নিজ যােগ্যতা অনুসারে মানসিক কিংবা শারীরিক শ্রমকে অবলম্বন করছে। তাই উভয় পরিশ্রমই মর্যাদার। মানসিক শ্রম যেমন ব্যক্তিমনে সুচিন্তা ও সদ্ভাব জন্ম দেয়, তেমনি শারীরিক শ্রমজীবী মানুষ সমাজ ও দেশকে সুন্দর ও কল্যাণকর করার প্রয়াসী হয়। এদের অবদান স্বীকার করে কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন–
‘গাহি তাহাদের গান —
ধরণীর হাতে দিল যারা আনি’ ফসলের ফরমান।
শ্রম কিনাঙ্ক-কঠিন যাদের নির্দয় মুঠি-তলে
ত্ৰস্তা ধরণী নজরানা দেয় ডালি ভরে ফুলে ফলে।’
ব্যক্তিজীবনে শ্রমের গুরুত্ব:
শ্রমবিমুখ ব্যক্তি কখনােই জীবনকে সুন্দর করে গড়ে তুলতে পারে না। সামাজিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হতে হলে প্রত্যেক ব্যক্তিকেই শারীরিক ও মানসিক শ্রমকে সমান মূল্য দেয়া উচিত। অন্যথায় জীবনে নেমে আসে অভিশাপ। বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিদের জীবন পর্যালােচনা করলে আমরা দেখতে পাই, নিরলস শ্রম সাধনাই তাদের সাফল্যের একমাত্র কারণ। সমষ্টিগত জীবনকে সুন্দর ও মহিমাময় করতে শ্রমের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। কিন্তু ব্যক্তিজীবনে শ্রমের গুরুত্ব আরও গভীর ও ব্যাপক। কেননা শ্রমন্মুিখ ব্যক্তি সাফল্যের ছোঁয়া থেকে চিরকালই বঞ্চিত। পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর পত্রিকার পাতায় ফুটে ওঠে এমন অনেক ছাত্রের ছবি, যাদের আর্থিক সংগতি শূন্যের কোটায়। তবুও একমাত্র কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমেই তারা। পরীক্ষায় অসাধারণ সাফল্য অর্জন করছে। দৈহিক ও মানসিক পরিশ্রমের ফলেই তারা জীবনকে সুন্দর করে তুলছে। একইভাবে ইতিহাসবিখ্যাত ব্যক্তি জর্জ ওয়াশিংটন, আব্রাহাম লিঙ্কন, আলবার্ট আইনস্টাইন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাক্সিম গাের্কি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখ ব্যক্তির জীবন থেকেও আমরা একই শিক্ষা গ্রহণ করি। শ্রমবিমুখত ব্যক্তিকে ব্যর্থতার গ্লানিতে পর্যবসিত করে, তার অগ্রগতির পথকে করে রুদ্ধ। তাই ব্যক্তিজীবনের সাফল্য শ্রমেরই সাফল্য।
সভ্যতা বিকাশে শ্রম:
মানবসভ্যতার বুনিয়াদ তৈরি করেছে শ্রম। একদিন গুহাবাসী মানুষ জীবন সংগ্রামের তাগিদে পাথরের নুড়ি দিয়ে শ্রমের সাহায্যে হাতিয়ার তৈরি করতে শিখেছিল। তারপর লক্ষ-কোটি মানুষের তিল তিল শ্রমে গড়ে উঠেছে। আজকের সভ্যতার বিজয়স্তম্ভ। মানুষ যদি নিষ্কর্মা হয়ে ভাগ্যের হাতে আত্মসমর্পণ করে বসে থাকত তাহলে আমাদের সামনে এ সমুন্নত সভ্যতার বিকাশ হতাে না । শ্রমের শক্তিতেই মানুষ নতুন নতুন সামাজ্যের পত্তন করেছে, করেছে সভ্যতার ক্রমবিস্তার। শ্রম ব্যক্তিজীবনকে সমৃদ্ধ ও ঐশ্বর্যশালী করে তারই প্রভাব পড়ে সমাজজীবনের ওপর। তাই শুধু ব্যক্তিজীবনের বিকাশ নয়, সভ্যতার বিকাশেও শ্রমই হাতিয়ার। বিষপানে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, যে জাতি যত বেশি পরিশ্রমী সে জাতি তত বেশি উন্নত। রাশিয়া, চীন, আমেরিকা, জার্মানি, জাপান প্রভৃতি দেশ শ্রমের প্রক্রিয়াতেই এত বেশি উন্নত। যুগ যুগ ধরে মানুষের কঠোর শ্রমই পৃথিবীকে বাসযােগ্য করেছে, সভ্যতাকে করেছে সমৃদ্ধ একবিংশ শতাব্দীর উন্নত ও প্রগতিশীল সভ্যতাও মানুষের নিরলস শ্রমের ফসল।
উপসংহার:
পৃথিবী সৃষ্টি থেকে বর্তমান পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে শ্রমের অবদান অপরিসীম। ব্যক্তিজীবন থেকে জাতীয় জীবনের কাঙ্ক্ষিত সাফল্য একমাত্র শ্রমশক্তির মাধ্যমেই সম্ভব। তাই দেশের জন্য, মাজের জন্য অবস্থান ও দক্ষতা অনুযায়ী যে পরিশ্রমই করা হোক না কেন তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। সব শ্রেণির শ্রমকে যদি সমান মর্যাদা দেয়া হয় তবেই দেশ ও জাতির যথার্থ কল্যাণ সাধিত হবে। সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশের জন্য সব ধরনের শ্রমই প্রয়ােজনীয়— এ বােধই পারে সব ধরনের শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলােতে শ্রমের এবং শ্রমজীবী মানুষের অধিকার ও মর্যাদা স্বীকৃত। আমাদের দেশের উন্নতিও এ মূল্যবােধের মাধ্যমে সম্ভব।
2 comments
ধন্যবাদ অসাধারণ লেখনী। রচনাটা ভালো লাগল❤️
Excellent article and love to the authors.