সেই ধন্য নরকুলে লােকে যারে নাহি ভুলে মনের মন্দিরে নিত্য সেবে সর্বজন ভাবসম্প্রসারণ
মূলভাব : কর্মই মানুষকে মহৎ করে তােলে। এ জগতে অনেকে তাদের মহৎ কর্ম, ভালােবাসা ও অধ্যবসায় দ্বারা স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন। মরেও তারা অমর।
সম্প্রসারিত ভাব : অফুরন্ত সৌন্দর্যের ক্ষণস্থায়ী এক মধুর নিকুঞ্জ আমাদের এ পৃথিবী। ক্ষণস্থায়ী এ পৃথিবীতে মৃত্যু-এক অনিবার্য সত্য। মৃত্যুর ধ্বংসলীলার মাধ্যমে মানুষের নিথর দেহের বিলুপ্তি ঘটলেও তার মহৎ কর্মের সুরভী কখনাে শেষ হওয়ার নয়। তার এ মহৎ কর্ম যুগ থেকে যুগান্তরে ঘুরে বেড়ায় মহাকালের ঘূর্ণনচাকায়। কাজেই মানুষ যদি যথার্থ কাজ করে যেতে পারে, তবে মৃত্যু তার নশ্বর দেহ নিশ্চিহ্ন করে দিলেও তার কর্মের সুফল ও খ্যাতির আলােকবর্তিকায় সমুজ্জ্বল হয়ে ওঠে পার্থিব জগৎ। কর্মগুণে তিনি চিরঞ্জীব হয়ে থাকেন মানুষের মণিকোঠায়। মানব মনের মন্দিরে প্রতিটি মানুষ তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে থাকে। তাই কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক, সমাজসেবী, রাষ্ট্রনায়ক প্রভৃতি প্রতিভাবান ব্যক্তিরা যুগ যুগ ধরে স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে রয়েছেন। পক্ষান্তরে, যারা নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন; সমাজ, দেশ ও জাতির মঙ্গলের জন্য কিছুই করেননি-মৃত্যুর সাথে সাথে মুছে গেছে তাদের নাম। কেউই তাদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে না।
মন্তব্য : মানুষ বিচিত্র মনের অধিকারী। সবার জন্য যার হৃদয়ে প্রেম, পরার্থে যার জীবন উৎসর্গীকৃত তার জীবনই ধন্য,
সার্থক।
একই ভাবসম্প্রসারণের ভিন্ন প্রতিলিপন
ভাবসম্প্রসারণ: মানুষের জীবনের সার্থকতা আসে বৃহত্তর কল্যাণে আত্মনিয়ােগের মাধ্যমে। যারা কেবল আত্মসুখে নিমগ্ন থাকে তাদের জীবন পদ্মপাতার ওপর শিশির বিন্দুর মতােই ক্ষণস্থায়ী । কিন্তু যারা অপরের সেবায় নিঃস্বার্থভাবে নিজেকে বিলিয়ে দেয় তারা যুগ যুগ ধরে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকে। পরার্থপরতা এমনই মহৎ, যা মানুষকে অমর করে রাখে। প্রকৃতির শাশ্বত ও চিরন্তন নিয়মানুযায়ী প্রত্যেক মানুষেরই জীবনাবসান হয়। মানুষ হারিয়ে যায় পৃথিবী থেকে। পেছনে পড়ে থাকে তার কর্মকীর্তি। যারা সংকীর্ণমনা ও স্বার্থপর জীবদ্দশায় যেমন তাদের কেউ ভালােবাসে না, তেমনি মৃত্যুর পরও তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় । কিন্তু যারা পরের সেবায় আত্মনিবেদনে সুখ খুঁজে পায় তারা অন্যকেও সুখী করতে পারে, দুঃখী মানুষের মুখে ফোটাতে পারে হাসি। তাদের জীবন সার্থক ও ধন্য। কেননা মানুষের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করার মধ্যেই জীবনের সার্থকতা, সেখানে ব্যক্তিস্বার্থের কোনাে স্থান নেই। মানুষ পৃথিবীতে তার কাজের মাধ্যমে বেঁচে থাকে। ভালাে কাজ করে মহান মানুষ পরের কল্যাণ সাধন করে। মহৎ কাজে নিবেদিতপ্রাণ পরােপকারী মানুষ পরের কল্যাণে নিজের জীবন উৎসর্গ করে। তারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে, পরার্থে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়াই মহত্ব। মানুষের বৈশিষ্ট্য ও তাদের কল্যাণস্পর্শে মানুষ উপকৃত হয়। সমাজ, দেশ ও জাতি হয় সমৃদ্ধ। এ ধরনের পুণ্যকর্মের মাধ্যমে মানুষ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নেয়। সারাবিশ্বের মানুষ সেসব অবদানের কথা স্মরণ করে। এ পৃথিবীতে যারা এমন আত্মত্যাগের মহিমায় মহিমান্বিত হয়ে আছেন তারা সকলেই পরহিত ব্রতে ব্ৰতী। এমনই কয়েকজন বরেণ্য
ব্যক্তিত্ব হলেন হাজি মুহম্মদ মহসীন, ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল, মাদার তেরেসা প্রমুখ। এসব মনীষীর সারাটা জীবন কেটেছে অপরের কল্যাণে নিজেকে নিবেদিত করে। এ আত্মত্যাগের মধ্যেই তারা আত্মসুখ খুঁজে পেয়েছেন। যুগ যুগ ধরে তারা মানুষের কাছে প্রণম্য। তাই বলা হয়, সুকর্ম কখনাে বৃথা যায় না, সেবাব্রতীজন চিরকাল স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে থাকেন। তাই অপরের দুঃখ-যন্ত্রণা লাঘবের জন্যে পরের কল্যাণে জীবনকে বিলিয়ে দিতে পারলে জীবন হয়ে ওঠে সার্থক— মানুষ হয় অমর।