Table of Contents
স্বদেশপ্রেম রচনার সংকেত(Hints)
- ভূমিকা
- স্বদেশপ্রেমের স্বরূপ
- স্বদেশপ্রেমের প্রকাশ
- স্বদেশপ্রেমের উপায়
- স্বদেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত
- স্বদেশপ্রেম ও বিশ্বপ্রেম
- উপসংহার
স্বদেশপ্রেম রচনা
ভূমিকা:
মা, মাটি, দেশ— এ তিনের সাথে মানবমনের রয়েছে অবিচ্ছেদ্য বন্ধন। এ তিনকে নিবিড়ভাবে ভালােবাসার মধ্যেই নিহিত আছে দেশপ্রেম। বিশাল পৃথিবীর যে সুনির্দিষ্ট ভৌগােলিক অংশে মানুষ জন্মগ্রহণ করে তাই তার স্বদেশ, তার মাতৃভূমি । মানুষ তার স্বভাবজাত গুণে অনিবার্যভাবে স্বদেশের মাটি, পানি, বায়ু অর্থাৎ সবকিছুর সাথে অনুভব করে নাড়ির টান, স্বদেশ হয়ে ওঠে তার কাছে সবচেয়ে পবিত্রভূমি এবং স্বদেশের প্রতি মনে জাগে অনন্য ভালােবাসা। দেশমাতৃকার প্রতি মানুষের এ অনুভব ও ভালােবাসাই হলাে স্বদেশপ্রেম ।
স্বদেশপ্রেমের স্বরূপ:
জন্মভূমির প্রতি মানৰ্মনের আবেগময় অনুরাগ মানুষের চিরন্তন বৈশিষ্ট্য। জন্মভূমির আলাে-বাতাস, পানি, ফসল মানুষকে মায়ের মমতা দিয়ে বড় করে তােলে। তার ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এককথায় স্বদেশের নানা উপাদান মানবমনের বিকাশের মাধ্যমে করে তােলে পরিপুষ্ট। তাই স্বদেশ ও স্বজাতির প্রতি মানুষের মনে জন্ম নেয় আত্মার গভীর টান এবং চিরায়ত অকৃত্রিম ভালােবাসা। যে অনুভূতি, যে ভালােবাসা দেশের কল্যাণে প্রয়ােজনে আত্মবিসর্জনে উদ্বুদ্ধ করে। দেশের প্রতি গভীর অনুরাগ মানুষের হৃদয়ে জন্মদাত্রী আর জন্মভূমিকে এক করে ভাবতে শেখায়। এ তীব্র অনুরাগই ‘স্বদেশপ্রেম’। একজন দেশপ্রেমিকের কাছে তার দেশ চির পবিত্র, চির অরাধ্য এবং স্বর্গের চেয়েও গরীয়ান। তাই দেশ ক্ষুদ্র কিংবা দরিদ্র হােক, তাতে দেশপ্রেমিকের কিছু যায় আসে না। কেননা দেশ যেমনই হােক তা দেশপ্রেমিকের কাছে অমূল্য, অতুল্য। ফলে দেশকে রক্ষা করার জন্যে সে নির্দ্বিধায় করতে পারে জীবনদান। তাই তাে স্বদেশের প্রতি গভীর অনুরাগে কবিগুরু বলেছেন-
‘যে তােমায় ছাড়ে ছাড়ুক, আমি তােমায় ছাড়ব না মা,
আমি তােমার চরণ –
মা গাে, আমি তােমার চরণ করব শরণ, আর কারাে ধার ধারব না মা ॥
কে বলে তাের দরিদ্র ঘর, হৃদয়ে তাের রতনরাশি –
আমি জানি গাে তার মূল্য জানি, পরের আদর কাড়ব না মা।
স্বদেশপ্রেমের প্রকাশ:
স্বদেশের প্রতি ভালােবাসা মানবহৃদয়ে সর্বদাই বহমান। মনের গভীর অনুরাগ থেকে জন্ম নেয়া স্বদেশপ্রেম প্রকাশ পায় বিশেষ সময়ে বিশেষ পরিস্থিতিতে বিচিত্র কার্যকলাপের মাধ্যমে। বিশেষত দেশ ও জাতির দুর্দিনেই স্বদেশপ্রেমের পূর্ণ প্রকাশ ঘটে। দেশ ও জাতির কল্যাণ সাধনের মাধ্যমেই দেশের প্রতি ভালােবাসার উৎসারণ ঘটে।দেশপ্রেমের আবেগময় প্রকাশ ঘটেছে কবিগুরুর কবিতায়।
বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল –পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান ॥
বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান।।
বাঙালির পণ, বাঙালির আশা, বাঙালির কাজ, বাঙালির ভাষা। সত্য হউক, সত্য হউক, সত্য হউক হে ভগবান।
জাতীয় জীবনের দুঃসময়ে স্বদেশপ্রেম প্রবল হয়ে ওঠে। কোনাে বিদেশি অপশক্তি যখন দেশকে পরাধীনতার অন্ধকারে টেনে নিতে চায় তখন স্বদেশপ্রেমই মুক্তিতে সামিল হবার জন্যে জাতির মনে চেতনা জাগায়। দুর্বার প্রাণশক্তিতে স্বদেশের সম্মান রক্ষার জন্যে মানুষকে আত্মত্যাগের মহামন্ত্র শিক্ষা দেয়। দেশপ্রেম মানুষকে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে একই প্রাণের বন্ধনে আবদ্ধ করে। কারাে কাছে মাথা নত করা নয় বরং মাথা উঁচু করে সম্মানের সাথে বাঁচতে শেখায়। তাই দেশপ্রেমিক আপন দেশের মর্যাদা রক্ষার জন্যে সর্বস্ব ত্যাগ করতে প্রস্তুত হয়। দেশপ্রেম ধনী-দরিদ্র, ক্ষুদ্র বৃহৎ সব ধরনের ব্যবধান ঘুচিয়ে একই জাতি হিসেবে বেঁচে থাকার মহৎ শিক্ষা দান করে। স্বদেশপ্রেমের প্রকাশ ঘটে বিদেশের অপরিচিত পরিবেশে। বিদেশের মাটিতে নিজ দেশের মাটির গন্ধ না থাকায় মন হয়ে ওঠে চঞ্চল। স্বদেশের প্রকৃতি ও মানুষের সান্নিধ্য কামনায় মনে জাগে তীব্র আকুলতা। তাইতাে কবির কামনা-
এই বাংলার আকাশ-বাতাস।
এই বাংলার ভাষা
এই বাংলার নদী, গিরি বনে।
বাঁচিয়া মরিতে আশা।’
স্বদেশপ্রেমের উপায়:
শিক্ষা, যােগ্যতা ও অবস্থানের ভিন্নতাভেদে নানান মানুষ নানান অবস্থানে থাকে। কিন্তু প্রতিটি মানুষ স্বীয় অবস্থান থেকেই দেশের উপকার সাধন করতে পারে। ছােট থেকে বড় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই স্বদেশপ্রেমের পরিচয় দেওয়া যায়। দেশ ও জাতির কল্যাণসাধনের উদ্দেশ্যে কিছু করার মধ্যেই দেশপ্রেম নিহিত আছে তা ছােটই হােক আর বড়ই হােক। নিজের স্বার্থ, নিজের দৈন্যদশাকে তুচ্ছ করে দেশ ও জাতির বৃহত্তর কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করার মহান ব্রত গ্রহণ করতে হবে। অবস্থানভেদে কৃষক যেমন ফসল উৎপাদন করে দেশের কল্যাণ সাধন করতে পারেন। তেমনি একজন। শিল্পী কিংবা সাহিত্যিক শিল্প-সাহিত্য চর্চার মাধ্যমে বিশ্বদরবারে দেশের গৌরব বৃদ্ধি করতে পারেন। তবে স্বদেশপ্রেমের নামে উগ্র জাতীয়তাবােধ বর্জনীয়। কেননা অন্ধ স্বদেশপ্রেম এবং উগ্র জাতীয় চেতনা মানুষকে সংকীর্ণ করে বিরােধের জন্ম দেয়।
স্বদেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত:
যুগে যুগে অনেক বরেণ্য ব্যক্তি দেশ ও জাতির কল্যাণে জীবন উৎসর্গ করে স্বদেশপ্রেমের উজ্জ্বল। দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। সারা বিশ্বের মানুষ তাদের স্মরণ করে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালােবাসায়। তাঁদের দৃষ্টান্ত বর্তমান ও অনাগত কালের মানুষের জন্যে হয়ে থাকবে চিরন্তন প্রেরণার উৎস। এ উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যেসব দেশপ্রেমিক অমূল্য অবদান রেখেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন মহাত্মা গান্ধী, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, এ কে ফজলুল হক, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, চিত্তরঞ্জন দাশ, তিতুমীর প্রমুখ। তাছাড়া তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক পাশা, ইতালির গ্যারিবাল্ডি, রাশিয়ার লেনিন, আমেরিকার জর্জ ওয়াশিংটন, চীনের মাও সেতুং প্রমুখ দেশপ্রেমিক ব্যক্তিরা চির অম্লান হয়ে থাকবেন । আমাদের দেশের ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে আত্মবিসর্জিত অসংখ্য শহিদও আমাদের দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করবে চিরদিন। দেশের প্রতি এসব দেশপ্রেমিকের ভালােবাসা ইতিহাসে অম্লান ঔজ্জ্বল্যে ভাস্বর থাকবে চিরকাল ।
স্বদেশপ্রেম ও বিশ্বপ্রেম:
স্বদেশপ্রেম মূলত বিশ্বপ্রেমেরই ভিত্তি। বিশ্বভ্রাতৃত্ববােধের চেতনা সার করতে না পারলে প্রকৃত স্বদেশপ্রেম সম্ভব নয় । দেশ, দেশের মাটি ও দেশের মানুষকে ভালােবাসার মধ্য দিয়ে মানুষ বিশ্ববাসীকে ভালােবাসতে শেখে। স্বদেশপ্রেমের মাধ্যমে মানুষ সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উঠে বৃহত্তর প্রাণের মিলনে সাড়া দেয়। তাই প্রকৃত স্বদেশপ্রেম আর বিশ্বপ্রেমের মধ্যে কোনাে বিরােধ নেই। স্বদেশপ্রেমের মধ্যে বিশ্ব ঐক্যের মন্ত্র প্রােথিত আছে বলেই রবীন্দ্রনাথ, শেক্সপিয়র, নিউটন, নজরুল দেশ-কালের গণ্ডি অতিক্রম করে বিশ্বের সকল মানুষের হয়েছেন। দেশমাতা আর বিশ্বমাতা যে একই সম্পর্কে বাধা তা আমরা কবিগুরুর বাণীতেই খুঁজে পাই – ও আমার দেশের মাটি, তােমার পরে ঠেকাই মাথা তােমাতে বিশ্বময়ীর–– তােমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা।
উপসংহার:
স্বদেশপ্রেম মানুষের অন্যতম মহৎ গুণ। মানুষকে সকল প্রকার ক্ষুদ্রতা, সংকীর্ণতা, স্বার্থপরতা থেকে মুক্ত করে বৃহৎ ও মহত্বের সন্ধান দেয় স্বদেশপ্রেম । তা মানুষের মানবিক মূল্যবােধের বিকাশ ঘটায়। প্রয়ােজনে দেশ ও জাতির কল্যাণে জীবন বিসর্জন দিতে শেখায়। তাই দেশ ও জাতিকে সমৃদ্ধ করতে হলে, বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে স্বদেশপ্রেমের চেতনা অপরিহার্য। দেশগঠনের জন্যে সে মানবতাবাদী দেশপ্রেমিক প্রয়ােজন যিনি এডউইন আর্নল্ডের মতাে মুক্তকণ্ঠে ঘােষণা- জীবনকে ভালােবাসি সত্য, কিন্তু দেশের চেয়ে বেশি না।