Faria Hasan / December 29, 2020
Table of Contents
আধুনিক নগরজীবন বড় কঠিন ও রূঢ় বাস্তব জীবন। এ জীবনে ব্যস্ততা আছে, মমতা নেই। এখানে জীবনের কোলাহল আছে, স্নেহ-প্রেম যেন নির্বাসিত। তবুও নগরজীবনই মানুষের কাম্য আর ওখানেই নগরজীবনের সার্থকতা । তাই মানুষ গ্রামকে দিনে দিনে পেছনে ফেলে নগরমুখী হয়ে পড়ছে, সকলেই চায় নাগরিক জীবনের স্বাদকে একবার হলেও অভিজ্ঞতায় নিয়ে আসতে।
নগরজীবন পল্লিজীবনের বিপরীত জীবন। নগরজীবনে মানুষ আর মানুষ। মানুষের পর্যাপ্ততা এখানকার সাধারণ দৃশ্য। ইট-পাথরের বাড়িঘর, সুউচ্চ ইমারত, দিকে দিকে নগরের পরিচিত চিত্র। অফিস, আদালত, কলকারখানা, ছােটবড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিল্পকারখানা সব মিলিয়ে নগর যেন দালানকোঠার অরণ্য। এখানে গ্রামের মেঠো পথ নেই, পথেbচলে না গরুর গাড়ি, আর বধূটিও গেয়ে ওঠে না ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই, কত রব আমি পন্থের পানে চাইয়া রে’। এখানে আছে পিচঢালা পথ, পথে ছুটে চলে মানুষ । ছুটে চলে শত সহস্র মােটর গাড়ি, গাড়ির শব্দে আর মানুষের কোলাহলে কান বন্ধ হয়ে আসে – যেন শব্দ উৎপাদন করাই নাগরিকের কাজ। নগরে পাখির কিচিরমিচির নেই, আছে খাদ্য সন্ধানী কাকের কলরব । অবিশ্রাম খাটুনি নগরের মানুষের প্রতিদিনকার স্বাভাবিক কাজ।
নাগরিক জীবনে রূঢ় কঠিন বাস্তবতা যেমন আছে, তেমনি আছে জীবন ধারণের অনিবার্য চাহিদাগুলাের নিশ্চয়তা। চিকিৎসা ও শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকারের মধ্যে অন্যতম । এ শিক্ষা ও চিকিৎসার উপযুক্ত জোগান পেতে হলে নগরজীবনের বিকল্প নেই। দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষার পাদপীঠ বিশ্ববিদ্যালয় নগরে বা নগরের নিকট উপকণ্ঠে অবস্থিত। উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সাধ পূরণ করতে হলে নগরজীবনকে গ্রহণ না করে সম্ভব নয় । গ্রামে একজন মানুষের অসুস্থতা দেখা
দিলে তাকে ভাঙা সড়কপথে চিকিৎসা কেন্দ্রে নিতে নিতে তার প্রাণ থাকে না আর । অথচ শহরের মানুষ তার হাতের নাগালেই পাচ্ছেন ডাক্তার, হাসপাতালের সেবা ইত্যাদি । নগরজীবনে মানুষ শিক্ষিত হােক আর অশিক্ষিত হােক জীবিকার জন্যে তার কোনাে না কোনাে কাজ আছেই আছে। নগরের স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নত । ফলে সঠিক চিকিৎসা লাভে রােগী সুস্থ হবার আশা করতে পারেন; কিন্তু তা গ্রামে সম্ভব নয়। নগরজীবনের শিক্ষার মান অনেক উন্নত এবং সময়ােপযােগী। ফলে দক্ষ জনশক্তি
হিসেবে নিজেকে গড়ে তােলার সুযােগটি এখানে বিস্তৃত। নগরের মানুষ অধিকাংশই শিক্ষিত বলে এখানে সুশীল শ্রেণির মানুষদের নিয়ে একটি উন্নত সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত।
হাজারাে সুবিধা থাকা সত্ত্বেও নগরজীবনে অসংখ্য অসুবিধাও বর্তমান। এখানে মানুষ নিরতিশয় ব্যস্ত বলে মানুষে মানুষে কোনাে আত্মীয়তার বন্ধন সৃষ্টি হয় না। এখানে মানুষের মন হয়তাে আছে, নেই মমতার বন্ধন। নগরজীবনে শুধু কৃত্রিমতার সমাবেশ। মানুষে মানুষে সহৃদয়তার বড় অভাব এ জীবনে। অর্থ উপার্জনের পিছু ধাওয়া করতে করতে মানুষের প্রাণ এখানে ওষ্ঠাগত প্রায়। এখানে অপরের দুঃখে নিজের মনে সহজে সহানুভূতি জাগে না। দিনে রাতে এখানে মানুষ নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। অন্যের সাথে তার মিতালি গড়ে ওঠা কঠিন। ইট-কাঠের বসতবাড়িতে বসবাসরত মানুষ তার জীবনের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলে। তাই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বধূ’ কবিতায় বলেছেন।
‘ইটের পরে ইট, মাঝে মানুষ কীট
নাইকো ভালােবাসা, নাইকো খেলা।’
নগরজীবনে আছে জীবিকার জন্যে অর্থ উপার্জনের ব্যস্ততা। এখানে আমাদের আনন্দ নেই, প্রাণমাতানাে হাসি নেই । আর আছে যেটুকু সেটুকুও কৃত্রিমতার বাইরে নয়।
নাগরিক জীবনে মায়া মমতাহীন নিষ্ঠুরতা থাকলেও এ জীবন আমাদের কাছে কাম্য হয়ে ওঠে। নগরজীবনকে অস্বীকার করা সম্ভব হতাে যদি জীবনের বিপুল বাসনাকে নির্বাসন দেয়া সম্ভব হতাে। আমরা সুচিকিৎসা চাই, মানসম্মত জ্ঞান অর্জন চাই, আমরা বড় বড় শিল্পকারখানা গড়ে দেশকে উন্নত করতে চাই, জীবিকার উপায় চাই – অতএব, নগরজীবনকেই চাই। তাই নগরজীবনকে বাদ দিয়ে সভ্যতা, উন্নতি, আত্মবিকাশ কোনােটাই সম্ভব নয় । ফলে নগরজীবনের
প্রয়ােজনীয়তাও আমাদের কাছে অনস্বীকার্য।
বলা হয়ে থাকে, বিধাতা গড়েছে গ্রাম আর মানুষ গড়েছে শহর। মানুষ শহর বা নগরকে তৈরি করেছে তার জীবনের অনিবার্য তাগিদ থেকে। সে তাগিদ কখনাে ফুরিয়ে যাবার নয়। অতএব, নগরজীবনও কখনাে আবেদন হারাবার নয়। জীবনের প্রয়ােজনেই প্রয়ােজন নগরজীবন
FILED UNDER : রচনা