Home রচনা একটি পূর্ণিমা রাত বা, জ্যোৎস্না রাতে একদিন রচনা

একটি পূর্ণিমা রাত বা, জ্যোৎস্না রাতে একদিন রচনা

by Curiosityn
2 comments

একটি পূর্ণিমা রাত বা, জ্যোৎস্না রাতে একদিন রচনা

একটি রাতের অদ্ভুত সৌন্দর্যকে যদি বর্ণনা করতে যাই তাহলে প্রথমেই মনে আসে পূর্ণিমা রাতের কথা। পূর্ণিমা রাতে পৃথিবীর জলে-স্থলে নেমে আসে সুন্দরের দেবতা। মানুষের মনকে চন্দ্রগ্রস্ত করে দিয়ে এক মায়াময় মােহ রচনা করে রাতের চাদ। না আলাে না আঁধার – এমন এক রহস্যের মায়াজালে মানবমনকে বন্দি করতে পারে কেবল চাদনি রাত। চাদনি রাত এদেশের বিভিন্ন ঋতুতে রচনা করে নানা রূপের মায়াজাল । শরতে, হেমন্তে, শীত-বসন্তে নব নব রূপে জ্যোৎস্না আসে আমাদের প্রকৃতিতে।

শরতের মাঝামাঝি । শারদীয় অবকাশে তখন আমি গ্রামের বাড়িতে। বাড়ির পশ্চিমে জোড়া পুকুর। পুকুরের পাড় ধরেই বিস্তীর্ণ ঝিল । পূর্ণিমা রাত। ঘরে মন বেঁধে রাখা দায় মনের অজান্তেই হাঁটি হাঁটি করে সেই পুকুর পাড়ে চলে আসি। এক অপার বিস্ময়ে তাকিয়ে আছি আমি! মৃদু হাওয়ায় কাঁপছে পুকুরের জল আর ওপরে খেলা করছে চাদের আলাে। বর্ষার জোয়ারের জল কমতে কমতে গাঙের নিকটবর্তী প্রায়। তবুও চাদের আলােয় চিকচিক করে দূর থেকেই সৌন্দর্য বিলিয়ে যাচ্ছে ঝিলের জল। পুকুর পাড়ে সারিবদ্ধ খেজুর গাছ। এক পাশে বাতাবি লেবুর ঝােপ । বাঁশ বনে মৃদু বাতাসে পাতার খসখস শব্দ, দু-একটি বকের ডানা ঝাপটানাের আওয়াজ। কাশফুল ফুটে সাদা হয়ে থাকা পুকুরপাড় সমস্ত কিছুর ওপর আজ চাঁদ যেন ঔদার্যের মহিমা প্রকাশ করতে ব্যস্ত। যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই যেন চাদ কোলাকুলি করছে মাটির বসুধায়। চাঁদ তার তাপহীন কোমল আলােয় স্নান করিয়ে দিচ্ছে আমাকে, আমার চারপাশকে। জ্যোৎস্না ছড়িয়ে পড়েছে ঝিলের জলে, কাশফুলে। একটা সুন্দর মায়াপুরীতে যেন আমি দিকভ্রমের শিকার। মনে বেজে উঠছে কবিগুরুর কবিতার চরণ –

‘চাদের হাসি বাধ ভেঙেছে উছলে পড়ে আলাে।
ও রজনীগন্ধা, তােমার গন্ধসুধা ঢালাে ॥
পাগল হাওয়া বুঝতে নারে ডাক পড়েছে কোথায় তারে ফুলের বনে যার পাশে যাই তারেই লাগে ভালাে।’

ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না অথচ অন্তরে কোন মাধুর্যের ছোঁয়ায় যেন পুলকিত হয়ে আছি। আমি মুগ্ধ বিস্ময়ে চেয়ে আছি, পুলক শিহরণে ক্ষণে ক্ষণে রােমাঞ্চিত হচ্ছি । এত রূপ, এত বৈচিত্র্য, এমন গম্ভীর মুরতি, স্নিগ্ধ সজল সুহাসিনী রাত আর কখনাে আমি প্রত্যক্ষ করিনি। আমি ডুবে আছি একরাশ জ্যোৎস্নার জলে ।

এ চাদনি রাত আমার মনে এনে দিল নানা ভাবনা, নানা অনুভূতি। সত্যিই চাদনি রাতের মায়াময় কুহকে কে-না পড়ে! কত গীতিকার জ্যোৎস্না রাতের রূপে বিমুগ্ধ হয়ে তার গানে তুলে ধরেছেন জ্যোৎস্নার আবেদনকে। পৃথিবীর কত কত কবিতায় যে পূর্ণিমাকে উপমা হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে এর কোনাে সঠিক পরিসংখ্যান নেই। প্রতিবাদী কবি, বিদ্রোহী কবি সকল কবির কাব্য তেজস্বিতাই চাদের হাটে অনেক বেশি কোমল। বরং বিদ্রোহী কবির বিদ্রোহ পূর্ণিমা রাতে রূপান্তরিত হয় রােমান্টিকতায়। চিত্রশিল্পীর চিত্রপটে পূর্ণিমা রাত ধরা পড়ে এক অপরূপ সৌন্দর্যে।

এ জোৎস্না রাতে চোখে পড়ল গ্রাম ও শহর জীবনের পূর্ণিমা রাতের পার্থক্য। গ্রামীণ জীবনে ও নাগরিক জীবনে পূর্ণিমা রাতের সৌন্দর্য উপভােগে তারতম্য ঘটে। নগর জীবনে মানুষ বড় বেশি ব্যস্ত। এখানে তীব্র বেগে ধেয়ে চলে মানুষের জীবনপ্রবাহ। বৈদ্যুতিক বাতির ঝলকানিতে নানা রং-বেরঙের আলােয় আলােকিত হয়ে থাকে চারপাশ। তাই ব্যস্ত জীবনে এ আলাের ফাক দিয়ে ছাদে গিয়ে কেউ জ্যোৎস্নাযাপন করবে এমন সুযােগও খুব একটা মেলে না। তাই পূর্ণিমা রাত শহুরে জীবনে খুব বেশি আবেদন সৃষ্টি করতে পারে না। অন্যদিকে, উল্টোটি হচ্ছে গ্রামীণ জনপদে। পূর্ণিমা সেখানে সর্বব্যাপী । পূর্ণিমার আলােয় উঠোনে বসে দাদি-নানিরা শিশু-কিশােরদের সুয়ােদুয়াে রানির কিচ্ছা শুনাচ্ছে। সত্যিই যেন চাঁদের হাট বসিয়েছেন তারা। পূর্ণিমার আলােয় পালাগান আর পুঁথিপড়া শুনতে শুনতে মন নেচে ওঠে বিপুল আনন্দে।

পূর্ণিমা রাতে প্রকৃতি যেন হেসে উঠেছিল চন্দ্রকিরণের নরম স্পর্শে আলাে আর আঁধারের মায়ায় মিলন চাদনি রাতকে করেছিল অপরূপ । জ্যোৎস্না রাতের এ আলাে যেন পূর্ণ আলাে ছিল না। এ আলাে শুধু প্রকৃতিকে তীব্র অন্ধকার থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল খুব বেশি দূরের কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। তবুও যা স্পষ্ট কিংবা অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল তাতেও মন রােমাঞ্চিত হয়ে উঠেছিল। দূরের কাশবনকে মনে হয়েছিল যেন ঘােমটা টানা বধূ।

আলােক উদ্ভাসিত জ্যোৎস্লাশােভিত এ পূর্ণিমা রাতের কথা কখনাে বিস্মৃত হবার নয়। আমার অস্তিত্বে জাগ্রত সে রাত আমার জীবনকে যে আনন্দের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল সে আনন্দ আমার জীবনে অক্ষয় হয়ে থাকবে। শরতের রাতের পূর্ণিমা ছড়িয়ে পড়েছিল মাঠের বুকে, নদীর জলে, বাঁশ বাগানের মাথার ওপর চাদ আর আমি যেন গ্রাম্য মেঠো পথ ধরে হেঁটে চলেছিলাম এখানে সেখানে আমার চৈতন্যে সেই পূর্ণিমা রাত এখনাে অমলিন। আমার জীবনের কোনাে আনন্দের কাছে যদি ফিরে যেতে চাই তাহলে আমাকে ফিরতে হয় সেই পূর্ণিমা রাতের কাছে। যে রাতে আমি চন্দ্রগ্রস্ত হয়ে এক অপরূপ রূপের মাঝে হারিয়ে গিয়েছিলাম । আমার চৈতন্যে এখনাে মাঝে মাঝে নাড়া দিয়ে ওঠে একটি শরত্রজনী, একটি পূর্ণিমা রাত, একটি অফুরন্ত সুখের অনুভূতি।

2.4/5 - (5 votes)

You may also like

2 comments

Mizan Ahmed June 29, 2022 - 4:03 pm

আমার এ গল্পটি অনেক সুন্দর লেগেছে। এরকম আরও গল্প আপলোড করবেন।

Reply
Md.Shahadul Karim August 20, 2022 - 9:48 am

চমৎকার!

Reply

Leave a Comment