Sabbir8986 / December 30, 2020
Table of Contents
‘দুরন্ত ঘূর্ণি এই লেগেছে পাক, এই দুনিয়া ঘােরে বন বন, ছন্দে ছন্দে কত রঙ বদলায়’— সলিল চৌধুরীর এই গান থেকে আমরা অনুমান করতে পারি যে, এ পৃথিবী স্থির নয়; তা ক্রমাগত ঘুরছে অর্থাৎ গতিশীল। মানুষও এখানে গতিশীল জীবিকা বা জীবনের প্রয়ােজনে তাকে সদাসর্বদা ঘুরে বেড়াতে হয় বা গতিশীল থাকতে হয়। কিন্তু এই গতিশীলতা জীবনকে শ্রান্তির দিকে নিয়ে যায়; মানুষ তখন বিশ্রাম চায়, প্রথাগত কাজের বাইরে যেতে চায়। মানুষের এই মানবিক প্রয়ােজনেই সৃষ্টি হয়েছে অবসরকাল। অবসর মানুষকে শরীর ও মনের শ্রান্তি-ক্লান্তি থেকে প্রশান্তি প্রদান করে ।
মন ও শরীর উভয়কে ভিত্তি করেই মানুষ পৃথিবীতে বেঁচে থাকে। তাই শরীরের সুস্থতা যেমন মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অনস্বীকার্য; তেমনি মনের সুস্থতাও বাঁচার জন্য অপরিহার্য । মানসিক প্রশান্তির জন্য অবসর যাপন অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। মানসিক প্রশান্তি অনেকভাবেই হতে পারে; যেমন: বই পড়া, গান শােনা, ছবি আঁকা, কবিতা লেখা বা আবৃত্তি করা, সিনেমা দেখা, দর্শনীয় স্থানে ভ্রমণ করা, ঘরের যেকোনাে কাজ করা, বাগান করা ইত্যাদি। যে যেভাবে মানসিক আনন্দ লাভ করবে তাকে সেভাবে কর্মপন্থা বা চিন্তার জগৎ সৃষ্টি করে নিতে হবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, মানসিক প্রশান্তির মাধ্যম অবশ্যই সুস্থির-সুস্থ-সমাজ স্বীকৃত হতে হবে। অন্যের সমস্যা সৃষ্টি করে অবসর যাপন করলে তা গ্রহণযােগ্য হবে না।
কায়িক পরিশ্রমের সকল ভার বহন করে আমাদের শরীর। বিভিন্ন মানুষের কায়িক পরিশ্রমের ধরন বিভিন্নরকম। কিন্তু একটানা বা ক্রমাগত কাজ করা কোনাে মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়। তাই তাকে থামতে হয় এবং বিশ্রাম গ্রহণ করতে হয়। দিনের বা দিনান্তের কোনাে নির্দিষ্ট সময় তাকে একটু অবসর যাপন করতে হয়। অনেকে শরীরকে বিশ্রাম দেয়ার জন্য অবসরে ঘুমন; অনেকে আবার চেয়ারে বসে গা এলিয়েও বিশ্রাম করেন। তবে আধুনিক বিশ্বে শারীরিক অবসরের জন্য নানা ধরনের মজার ব্যায়াম ও ম্যাসাজিং আবিস্কৃত হয়েছে। সেগুলাে গ্রহণ করে অনেকেই শরীরকে সুস্থ রাখেন এবং অবসর যাপন করেন।
কোনাে মানুষই অবসরহীন কাজ করে যেতে পারে না। যদি কেউ এরকম চেষ্টা করেও থাকে তাকে নানা ধরনের অসুস্থতা ঘিরে ধরে। কারণ অবসর ও কাজ গভীরভাবে একে অন্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। কাজ মানুষকে স্ফুর্তি দেয় এবং তাকে বেঁচে থাকার রসদ জোগায়। অবসর যাপন মানুষের শরীর ও মনকে নবউদ্যমে ভরে তােলে । তাই অর্থ ও খ্যাতির মােহে অবসরহীন কাজ করা মােটেও কাম্য নয়। কারণ শরীর ও মন সুস্থ রাখা ভালাে কাজ করার পূর্বশর্ত; আর এ কারণে অবশ্যই বিশ্রাম গ্রহণ বা অবসর যাপন অত্যাবশ্যকীয়।
মানুষ তার সামর্থ্য ও সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী অবসর যাপন করে থাকে। কৃষক মাটিতে জন্ম দেয় নতুন ফসলের; পরিশ্রান্ত হয়ে গাছের নিচে বসে মনের সুখে গান ধরে সে। এটিই তার অবসর যাপন । নদীর মাঝিমাল্লা বা মাঠের রাখালও গান গায় বা বাঁশিতে সুর তোলে। অনেক শ্রমজীবীই কাজের মধ্যে সুযােগ করে ঘুমিয়ে নেয়। অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত ও অর্থসম্পন্ন মানুষের অবসর যাপন বেশ বৈচিত্র্যময়। তারা মানসিক ক্লান্তি দূর করতে শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা করে । কেউ কেউ নানা দেশে ঘুরে বেড়িয়ে অবসর যাপন করে। তবে বেশিরভাগ মানুষই শারীরিক ক্লান্তি দূর করতে ঘুমের আশ্রয় নেয়
পৃথিবীর ইতিহাসে পর্যালােচনা করলে দেখা যাবে মানুষ নানা পদ্ধতিতে অবসর যাপন করেছে । খ্রিষ্টের জন্মের আগে প্রাচীন গ্রিসে অবসর যাপনের জন্য নাটক মঞস্থ হতাে; তবে তা সীমিত সংখ্যক মানুষের জন্য প্রদর্শিত হতাে। রােমান সাম্রাজ্যে অবসর যাপনের জন্য পশুর লড়াই; মানুষ ও পশুর লড়াই; মানুষ ও মানুষের লড়াইয়ের আয়ােজন হতাে। সাধারণের জন্য তা উন্মুক্ত থাকলেও এর পরিণতি হতাে অত্যন্ত মর্মান্তিক। ভারতবর্ষসহ বিশ্বের অনেক দেশের রাজন্যবর্গই শিকারে গিয়ে বা মৎস্য শিকার করে অবসর যাপন করতেন। আবার অবসর যাপনের জন্য তারা বড় বড় প্রাসাদও নির্মাণ করেছেন, যা পরবর্তীকালে সাধারণ মানুষেরও মনােরঞ্জন করেছে। তবে বর্তমানকালে মানুষ অবসর যাপনের জন্য নানা ধরনের ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসের সাহায্য নেয়। তরুণ প্রজন্মের অবসর যাপনের অন্যতম একটি উপকরণ মােবাইল ফোন।
যদিও ছাত্রজীবন কঠিন পরিশ্রমের সময়কাল তবুও এ সময় তাকে কিছু অবসর কাটাতে হয়। তবে এই অবসরকেও সে সৃষ্টিশীল করে তুলতে পারে। মানসিক প্রশান্তি লাভের জন্য বই পড়া, গান শােনা, লেখালেখি করা বা কোনাে ক্রীড়ায় অংশ গ্রহণ করতে পারে সে । তাছাড়া অবসরকালেই একজন ছাত্র সামাজিক নানা কর্মসূচি যেমন: বৃক্ষরােপণ, মশা নিধন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান প্রভৃতি পরিচালনা করতে পারে ।
আমাদের এই দেশ আকারে খুব বড় নয়! আয়তনের তুলনায় এর জনসংখ্যা অনেক বেশি। বেঁচে থাকতে এখানে মানুষকে সর্বদা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা তার শরীর ও মনকে ক্লান্ত করে তােলে। একারণে এই ভূখণ্ডের মানুষের অবসর যাপন অত্যন্ত প্রয়ােজনীয় । আমাদের শহরাঞ্চলে বিনােদনের কিছু ব্যবস্থা থাকলেও গ্রামে প্রায় নেই বললেই চলে। কিন্তু প্রত্যেক মানুষকে নিজের মতাে করে অবসর যাপনের ব্যবস্থা করতে হবে । নাহলে ধীরে ধীরে তার কাজ করার প্রেরণা হারিয়ে যাবে।
শরীর ও মনকে সুস্থ করার জন্য অবসর যাপন অত্যাবশ্যকীয় । কিন্তু অনেকে জীবনের বেশিরভাগ সময়ই অবসরে কাটায়। একে আসলে অবসর যাপন না বলে অলসতা বলাই শ্রেয়। অলসতা জীবনকে কর্মবিমুখ করে। মানুষ কর্মের ক্লান্তি দূর করতে অবসর যাপন করে; কিন্তু অবসরকেই মুখ্য করে তােলা জীবনের উদ্দেশ্য হতে পারে না। তাই অবসরের নামে অলসতা কখনােই কাম্য নয়।
শ্রাম কাজের অংশ এক সাথে গাঁথা, নয়নের অংশ যেমন নয়নের পাতা’– কাজের ক্লান্তি ভুলতে বিশ্রাম বা
অবসর যাপন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটানা কাজ মানুষের ভেতরের মানবিক বােধকে ধ্বংস করে দিতে পারে। আবার অবসরকেই মুখ্য করে তুললে মানুষ কর্মবিমুখ হয়ে উঠতে পারে । তাই অবসর ও কাজ এই দুটি বিষয়ের সুন্দর একটি সমন্বয় করতে হবে। তবেই জীবন কর্মময় হয়েও সুখ ও শান্তিময় হবে।
FILED UNDER : রচনা