যানজটের কবলে রচনা লিখন
আমার বড় বােন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। হােস্টেলে থাকে। আমরা থাকি রাজধানী ঢাকার মােহাম্মদপুর এলাকায়। একবার সে বাসায় এসেছে কিন্তু তার খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বইয়ের ফটোকপি জোগাড় করতে হবে আজিজ সুপার মার্কেট থেকে। আমার স্কুল ছুটি। অগত্যা সেই দায়িত্ব আমার ওপরই বর্তালাে। আর আমারও হলাে এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। যানজটের কবলে পড়ে এমন অভিজ্ঞতা এর আগে আমার আর কখনাে হয়নি।
সেপ্টেম্বর মাসের কোনাে একটা দিন। বাইরে কাঠফাটা রােদুর, অসহ্য গরম । একেই বুঝি বলে ভাদ্র মাসের তালপাকা গরম ।মােহাম্মদপুর টাউন হল থেকে দুপুর বারােটায় চড়ে বসলাম সিটি বাস সার্ভিসে। আমার একটু আনন্দও হচ্ছিল । কেননা এ কাজের বিনিময়ে নতুন কোনাে গল্পের বই কেনার টাকা বাগিয়ে নিয়েছি আপুর কাছ থেকে।
টাউন হল থেকে শাহবাগ সর্বোচ্চ বিশ মিনিটের পথ । বাস ছেড়ে দিল। আমিও আরাম করে বাসের সিটে হেলান দিয়ে বসলাম। কিন্তু ভাগ্য যে তার পরিহাসের ঝুলি খুলে বসে আছে তা তাে বুঝিনি। নজরুল ইসলাম সড়ক হয়ে সাত মসজিদ সড়কে ঢােকার আগেই বাস থেমে গেল । ভাবলাম চার-পাঁচ মিনিটেই হয়তাে জ্যাম ছেড়ে যাবে। কিন্তু বিশ মিনিটের মাথায়ও বাস এক ইঞিও নড়ল না। বাসের ভেতর যাত্রীরা ক্রমেই অসহিষ্ণু হয়ে উঠছেন। কেউ ভাগ্যকে শাপ-সাপান্ত করছেন, কেউবা ঢাকার অপরিকল্পিত রাস্তাঘাট এবং রাস্তার স্বল্পতা নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করছেন।
আধা ঘণ্টা পার হয়ে গেছে, বাস এক চুলও নড়ল না। বাসের ভেতর অসহ্য গরম। সূর্য যেন আরও তেতে উঠেছে। চারদিক থেকে ভেসে আসছে নানারকম আওয়াজ । গাড়ির অসহিষ্ণু ড্রাইভারদের বিরামহীন হর্ন, রিকশাওয়ালাদের চিৎকার— সব। মিলিয়ে এক ভয়াবহ অবস্থা । আমাদের বাসে একটা ছােট্ট বাচ্চা চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিয়েছে। মা নানাভাবে বাচ্চাটিকে
শান্ত করতে চাইছেন।
আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, বাস থেকে নেমে কিছুদূর হেঁটে গিয়ে সামনে থেকে রিকশা নেব। নামলাম। কিছুটা পথ হেঁটে সাত মসজিদ রােড দিয়ে যখন বের হলাম তখন আমার চক্ষু চড়কগাছ । যতদূর চোখ যায় শুধুই স্থবির যানবাহনের জট, যেন বিশাল মিছিল । রিকশা, অটোরিকশা, ট্যাক্সি ক্যাব, কার, বাস, মাইক্রোবাস-
কী নেই সেই মিছিলে! অনেকেই নেমে হাঁটা শুরু করেছেন। এখন যানজটের পাশাপাশি শুরু হয়ে গেছে জনজট। ধীরে ধীরে হাঁটতে হচ্ছে। বারবার পকেটে হাত দিয়ে দেখছি সব ঠিকঠাক আছে কি না। যতই হাঁটি রাস্তা আর শেষ হয় না। জিগাতলা পর্যন্ত এসে রাস্তার পাশে একটা দোকান থেকে পানি কিনে খেলাম । আবার শুরু করলাম হাঁটা। দেখলাম, রাস্তার মােড়ে মােড়ে ট্রাফিক পুলিশ আর সার্জেন্টদের অসহায় তৎপরতা । জট ছাড়াতে তারা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন । প্রচণ্ড রােদে ট্রাফিক পুলিশ, সার্জেন্ট, রিকশাওয়ালা, যাত্রী, পথচারী সবার প্রাণ ওষ্ঠাগত। এক অটোরিকশা চালকের সাথে এক রিকশাওয়ালার ঝগড়া লেগে গেল। হাঁটতে হাঁটতে আমি দেখলাম, মুহর্তেই তা হাতাহাতির পর্যায়ে চলে গেছে। কী নিয়ে এ ঝগড়া তা আমার জানা নেই। হয়তাে নিতান্তই তুচ্ছ কোনাে বিষয়। কেননা এমন পরিস্থিতিতে তুচ্ছ বিষয়ে মেজাজ খারাপ হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।
যানজটে স্থির গাড়িগুলাের মাঝখানে ফেরিওয়ালারা রুমাল, পানির বােতল, হাতপাখাসহ নানান জিনিস ফেরি করে বেড়াচ্ছে। লাইন পড়ে গেছে ভিখিরিদেরও। আরেকটু সামনে এগুতেই দেখলাম একটা অ্যাম্বুলেন্স। ভেতরে রােগী রয়েছে । অ্যাম্বুলেন্সের তীব্র হুইসেল আমার বুকের ভেতর শেলের মতাে বিধতে লাগল । কিন্তু নিরুপায় আমি স্বার্থপরের মতাে হাঁটতে শুরু করলাম। এতদূর হেটে, ঘেমে আমার অবস্থাও বিশেষ ভালাে নয়। শরীরটা ক্লান্ত, অবসন্ন লাগছিল। অবশেষে প্রায় দু ঘণ্টা পর আমি আমার কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌছলাম । কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে, হালকা কিছু খাবার খেয়ে বইয়ের ফটোকপি জোগাড় করলাম। কিন্তু তক্ষুনি বাড়ি ফেরার কথা ভাবতেই পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল, কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালােবাসে। এক ঘণ্টা আজিজ সুপার মার্কেটে কাটালাম । দুটো গল্পের বই কিনলাম। ততক্ষণে রাস্তা যানজটমুক্ত হয়েছে।
ফেরার পথে একরাশ ক্লান্তি নিয়ে বাসে উঠলাম। সেই একই পথ । কিন্তু কিছুক্ষণ আগের দৃশ্য আর মুহূর্তগুলাে ভেবে খুব অসহায় লাগছিল । জানি না অ্যাম্বুলেন্সের সেই রােগী আর তার স্বজনদের অবস্থা । যানজটে পড়ে দু ঘণ্টার এক বিরক্তিকর, তিক্ত আর বেদনাময় অভিজ্ঞতা নিয়ে বাড়ি ফিরলাম।
আরো দেখুন-
রচনা: যানজট ও এর প্রতিকার
অনুচ্ছেদ: যানজট