Faria Hasan / December 30, 2020
Table of Contents
পৃথিবীর ইতিহাস পর্যালােচনা করে দেখা গেছে যে, যখনই মনুষ্যসমাজ মনুষ্যত্বের আদর্শ থেকে দিগ্ভ্রান্ত হয়ে বিপথগামী হয়েছে, তখনই কোনাে না কোনাে মহাপুরুষ তাদের সঠিক পথের সন্ধান দিতে পৃথিবীর বুকে আবির্ভূত হয়েছেন। হজরত মুহম্মদ (স.) এমনই একজন মহাপুরুষ; যার আবির্ভাবে পাপ ও পঙ্কিলতায় পরিপূর্ণ আরববাসী ধর্ম ও ন্যায়ের পথের সন্ধান পেয়েছিল। তিনি আরবজাতিকে অন্ধকার থেকে মুক্তির পথ তথা আলাের পথের সন্ধান দিয়েছেন। তার প্রচারিত ধর্ম ইসলামের মহান আদর্শ বিশ্বব্যাপী সাম্য, মৈত্রী ও শান্তির উদাত্ত বাণী ছড়িয়ে দিয়েছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে তার প্রচারিত আদর্শ, কর্ম এবং মানবতার শিক্ষা অতুলনীয়।
আল্লাহ প্রেরিত সর্বকালের-সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হজরত মুহাদ (স.)। পৃথিবীর বুকে তিনি ইসলাম প্রচার করেছেন। বিশ্ববাসীর প্রিয় এই নবি ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই রবিউল আউয়াল আরবের সম্ভান্ত কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আবদুল্লাহ এবং মাতার নাম বিবি আমেনা। নবিজির জন্মের পূর্বেই তার পিতা ইন্তেকাল করেন। তাঁর বয়স যখন মাত্র ৬ বছর তখন তাঁর মাতাও ইহজগৎ ত্যাগ করেন। এরপর প্রথমে পিতামহ আবদুল মুত্তালিব এবং পরে পিতৃব্য আৰু তালিবের কাছে তিনি বড় হন। শৈশব থেকেই তার ভেতরের মহিমান্বিত গুণাবলি উদ্ভাসিত হতে শুরু করে। সত্যবাদিতার জন্য শিশুকালেই তিনি ‘আল-আমিন’ বা বিশ্বাসী’ উপাধিতে ভূষিত হন।
হযরত মুহম্মদ (স.) ২৫ বছর বয়সে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন। মহানবির মানবিক ও চারিত্রিকগুণে মুগ্ধ হয়ে মক্কার সম্ভান্ত ও ধনাঢ্য মহিলা বিবি খাদিজা (রা.) তাঁর সমস্ত ব্যবসায়-বাণিজ্যের দায়িত্ব নবিজির ওপর অর্পণ করেন । এরপর ক্রমেই তিনি নবিজির সত্যবাদিতা, বিশ্বস্ততা ইত্যাদি গুণাবলির প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন এবং তার সঙ্গেই বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন।
হযরত মুহম্মদ (স.) হেরা পর্বতের গুহায় আল্লাহর ধ্যানে গভীরভাবে মগ্ন থাকতেন। একদিন ধ্যানরত অবস্থায় আল্লাহর আদেশক্রমে ফেরেশতা জিব্রাইল (আ.) তাকে নবুয়তের সংবাদ প্রেরণ করেন। মহানবি (স.) ৪০ বছর বয়সে নবুয়ত লাভ করেন। তার ওপর পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল কোরআন নাজিল হয়। এরগ্রই তিনি নবি ও রসুল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তিনি পবিত্র আল কোরআনের বাণী সকল মানুষের মধ্যে প্রচার করেন। তাঁর মুখনিঃসৃত বাণী ও কোরআনের জীবন বিধানে আকৃষ্ট হয়ে আররে মানুষ দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে ।
হযরত মুহম্মদ (স.)-এর আবির্ভাবের পূর্বে দীর্ঘকাল আরবের মানুষ অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। তাদের মধ্যে কোনাে ঐক্য ছিল না; সর্বত্র অন্যায়-অত্যাচার, বিশৃঙ্খলা, অজ্ঞতা ও কূপমণ্ডুকতা বিদ্যমান ছিল। ছােটো ছােটো গােত্রে বিভক্ত ছিল বলে আরববাসীদের মধ্যে তখন রক্তপাত-যুদ্ধ ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। সেই জাহেলিয়ার যুগে মদ্যপান, ব্যভিচার, জুয়া, দস্যুবৃত্তি, নরহত্যার মতাে ঘৃণ্যকাজ করত আরবের অধিবাসীরা । তাছাড়া তারা ৩৬০টি দেবদেবীর মূর্তি স্থাপন করে পূজা করত। প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদান যেমন- মাটি, পানি, আকাশ, চন্দ্র, সূর্যের উপাসনা করত বিভিন্ন গােত্রের অধিবাসী। সে সময় তারা পরকালেও বিশ্বাস করত না। নারী ওই সমাজে পণ্যের মতাে বিক্রি হতাে এবং নারী-পুরুষের মধ্যে কোনাে পবিত্র বন্ধনও ছিল না ।
হযরত মুহম্মদ (স.) প্রথমে কুরাইশদের মধ্যে ইসলাম ধর্মের মহান বাণী ও সত্য প্রচার করতে চাইলেন কিন্তু তারা প্রবলভাবে নবিজির বিরােধিতা করল। অগত্যা তাকে মক্কা ত্যাগ করে মদিনায় চলে আসতে হলাে। নবিজির মক্কা থেকে মদিনায় গমনের এই ঘটনাকে ইসলামে ‘ হিজরত’ বলা হয়। তার মদিনায় আগমনের সম্মানার্থে মদিনার নতুন নামকরণ হয়— “মদিনাতুন্নবি’ বা ‘নবির শহর’। নবিজির আদর্শ ও ইসলামের অনুপ্রেরণায় যে সমস্ত মুসলমান জন্মভূমি ত্যাগ করে নবিজির মতাে মদিনায় গিয়েছিলেন তাদেরকে বলা হয় মােহাজেরিন’ আর যেসব মদিনাবাসী এই মুসলমানদের আশ্রয় প্রদান করেছিলেন তাদেরকে বলা হয় ‘আনসার’। ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে মদিনায় নবিজি প্রথম একটি ইসলামি রাষ্ট্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য মহানবিকে অসম্ভব কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। তাছাড়া তাঁকে বেশকিছু যুদ্ধও পরিচালনা করতে হয়েছে। এই যুদ্ধগুলাে বদর, ওহােদ ও আহ্যাব (খন্দক) যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত। ৬২৮ খ্রিষ্টাব্দে হজরত মুহম্মদ (স.) মক্কায় হজব্রত পালনের উদ্দেশ্যে গমন করলে কুরাইশদের সঙ্গে হুদাইবিয়া নামক স্থানে একটি সন্ধি স্বাক্ষর করেন। কিন্তু পরবর্তীকালে কুরাইশরা এই সন্ধি ভঙ্গ করে এবং নবিজির সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। কিন্তু ততদিনে মক্কার অনেক বীর যােদ্ধা ইসলাম গ্রহণ করেছে। ফলে মহানবি খুব সহজেই মক্কা জয় করেন। মহানবি মুসলমান ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করার চেষ্টা করেন। সকলের মধ্যে এই ঐক্য স্থায়ী করতে এবং মদিনাকে রক্ষার জন্য তিনি অসাধারণ এক সনদ প্রস্তুত করেন। তাঁর এই অসাধারণ সনদটিই ‘মদিনা সনদ’ হিসেবে খ্যাত যা মুসলমানদের জন্য লিখিত প্রথম শাসনতন্ত্র এই সনদ প্রদানের মধ্য দিয়ে হজরত মুহম্মদ (স.)-এর অসম্ভব বিজ্ঞতা ও দূরদর্শিতার প্রমাণ পাওয়া যায় ।
আরববাসীর উদ্দেশ্যে হজরত মুহম্মদ (স.)-এর প্রথম ৰাণী ছিল “তােমরা, মূর্তিপূজা ত্যাগ করাে এবং আল্লাহর অস্তিত্বকে স্বীকার করাে।” তিনি উচ্চারণ করেন ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ’- অর্থাৎ এক ভিন্ন অন্য কোনাে উপাস্য নেই, হজরত মুহম্মদ (স.) আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ বা রসুল”। তাছাড়া পবিত্র কোরআনে। উল্লেখ করা হয়েছে হজরত মুহম্মদ (স.)-এর মধ্যে তােমরা জীবন-যাত্রার আদর্শের একটি সুন্দর উদাহরণ পাবে । প্রকৃত অর্থে এই বক্তব্যের মধ্যেই হজরত মুহম্মদ (স.)-এর চরিত্রের সারসংক্ষেপ নিহিত আছে। বিশ্বস্ততা, ন্যায়পরায়ণতা, সহিষ্ণুতা, ধৈর্যশীলতা, উদারতা, সহনশীলতা ইত্যাদি নানাবিধ মহৎ গুণের সমাবেশে হজরত মুহম্মদ (স.)-এর চরিত্র হয়ে ওঠে অতুলনীয় মাধুর্যমণ্ডিত। সত্যের প্রতি অবিচল নিষ্ঠাই তার সমগ্র জীবনকে সার্থক-সুন্দর করে অমরত্ব প্রদান করেছে।
হজরত মুহম্মদ (স.) তাঁর জীবনে যে আদর্শ ও বাণী রেখে গিয়েছিলেন তা আজ পর্যন্ত অম্লান হয়ে আছে । বিদায় হজে তাঁর উপদেশ বাণী চিরস্মরণীয়। তিনি আরাফাতের ময়দানে ঘােষণা করেছিলেন— ১. সব মানুষই এক আদমের সন্তান, সুতরাং এক দেশের লােকের ওপর অন্য দেশের লােকের আধিপত্যের কোনাে কারণ নেই; ২. এক মুসলমান অন্য মুসলমানের ভ্রাতা, সব মুসলমানকে নিয়ে এক অবিচ্ছেদ্য ভ্রাতৃসমাজ; ৩.মানুষের ওপর অত্যাচার করাে, কারাে অসম্মতিতে তার সামান্য পরিমাণ ধনও গ্রহণ করাে না; ৪. নারীজাতির প্রতি নির্মম ব্যবহার করাে না। সংসারে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার; নারীর প্রতি পুরুষের যে দাবি, পুরুষের প্রতিও নারীর সে দাবি; ৫, দাস-দাসীকে নির্যাতন করবে না, তাদের মর্মে ব্যথা দেবে না, তােমরা যা খাবে ও পরবে দাস-দাসীকেও তা খেতে ও পরতে দেবে।
মহানবি (স.) ছিলেন আমাদের জীবনের পথপ্রদর্শক। মানবজাতির আদর্শ এই মহাপুরুষ ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে ১২ই রবিউল আউয়াল মাত্র ৬৩ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। মানবজাতিকে তিনি যে আলাের পথ দেখিয়েছেন তা সর্বযুগের মানুষের আদর্শ হয়ে অম্লান থাকবে।
FILED UNDER : রচনা