Faria Hasan / March 12, 2021
Table of Contents
বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার পথে যেসব সমস্যা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তার মধ্যে অন্যতম জনসংখ্যা সমস্যা। একটি দেশে জনসংখ্যা জনশক্তি হিসেবে কাজ করে । রাষ্ট্র গঠনের আবশ্যকীয় উপাদানও জনসংখ্যা। কিন্তু জনসংখ্যা যখন। শক্তির বদলে সমস্যায় পরিণত হয় তখন দেশের অর্থনীতি ও উন্নয়নের গতি হয়ে পড়ে মশ্বর। বাংলাদেশের অর্থনীতি ও উন্নয়নও অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে বিপর্যস্ত সীমিত ভূখণ্ডে এক বিশাল জনগােষ্ঠী বাংলাদেশের জন্য অভিশাপ।
পঞ্চান্ন হাজার পাঁচশ আটানব্বই বর্গমাইলের ছােট্ট এ দেশটিতে বর্তমানে প্রায় যােলাে কোটি লােকের বাস। এদের মধ্যে পনেরাে বছরের কম এবং ষাট বছরের বেশি বয়সের লােকের সংখ্যা অধিক। জনগােষ্ঠীর এক বিরাট অংশ নিরক্ষর, এরা দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। সব মিলিয়ে দেশে কর্মহীন লােকের সংখ্যাই বেশি। ফলে। জনসংখ্যা সমস্যা আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল স্থির। কেননা সে সময় জন্মহার ও মৃত্যুহার দুই-ই ছিল বেশি। উনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে জনসংখ্যা বাড়তে থাকে ধীর গতিতে। এ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় । থেকে জন্মহারের তুলনায় মৃত্যুহার কমে যেতে থাকে। অর্থনীতিবিদ ম্যালথাস দেখিয়েছেন, পৃথিবীতে জনসংখ্যা যে হারে বাড়ছে, সম্পদের পরিমাণ সে হারে বাড়ছে না। ফলে দেখা দিচ্ছে খাদ্যঘাটতি। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ম্যালথাসের এ তত্ত্ব বিশেষভাবে প্রযােজ্য। জনসংখ্যা বৃদ্ধির মূলে প্রধান যে কারণগুলাে রয়েছে তা হলাে— জন্ম নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে অজ্ঞতা, অশিক্ষা, ধর্মীয় গোড়ামি, বাল্যবিবাহ ও বহুব্বিাহ, সামাজিক কুসংস্কার, নিম্নমানের জীবনযাত্রা ও দারিদ্র্য প্রভৃতি।
ম্যালথাসের তত্ত্ব অনুযায়ী, জনসংখ্যার অস্বাভাবিক বৃদ্ধির পাশাপাশি পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না থাকায় প্রকৃতিতে ভারসাম্যহীন অবস্থার সৃষ্টি হয়। একসময় প্রকৃতিই এর প্রতিশােধ নেয়। যুদ্ধ, মহামারি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রভৃতির মাধ্যমে জনসংখ্যা হ্রাস পায়, ফিরে আসে ভারসাম্য । বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে যে ভারসাম্যহীন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তার সুস্পষ্ট প্রকাশ ধনী-দরিদ্রের ব্যাপক ব্যবধান। বাংলাদেশে জনসংখ্যার এক বিশাল অংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। অশিক্ষিত, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, ধর্মীয়ভাবে গোড়া এদের মধ্যেই জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রবণতা বেশি। এভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে প্রধানত যে ধরনের সমস্যা দেখা দিচ্ছে তা হলাে—
১. প্রতি বছর ব্যাপক খাদ্য সংকট দেখা দিচ্ছে। ঘাটতি মেটাতে প্রতি বছর দশ থেকে পনেরাে লক্ষ টন খাদ্য বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এ খাতে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ের ফলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হচ্ছে না;
২. বাংলাদেশে শিল্পোন্নয়নের গতি মন্থর । তাই কৃষি বহির্ভূত খাতগুলােতে কর্মসংস্থানের সুযােগ কম। দেশে কর্মক্ষম লােক রয়েছে, কিন্তু কাজের সুযােগ নেই। ফলে বেকারত্ব বেড়ে চলেছে। দেখা দিচ্ছে সামাজিক বিশৃঙ্খলা । বেড়ে চলেছে অপরাধপ্রবণতা।
৩. বাসস্থান সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। কমে আসছে চাষের জমির পরিমাণ। কাজ ও বসবাসের আশায় নিম্ন আয়ের লােক গ্রাম থেকে শহরমুখী হচ্ছে। শহরে বেড়ে চলেছে বস্তিবাসীর ভিড়;
৪. জনগােষ্ঠীর এক বিরাট অংশ পর্যাপ্ত শিক্ষার সুযােগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বেড়ে চলেছে নিরক্ষর লােকের সংখ্যা।
৫. খাদ্য ও পুষ্টির অভাবে বিভিন্ন ধরনের রােগব্যাধির শিকার হচ্ছে দরিদ্র জনসাধারণ:
৬. বর্ধিত জনসংখ্যার চাপে কৃষিজমি ছােট ছােট খণ্ডে বিভক্ত হয়ে পড়ছে। ফলে উৎপাদন হচ্ছে ব্যাহত। অন্যদিকে, অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় বৃদ্ধির ফলে সঞ্চয় ও পুঁজিগঠনের হারও অনেক কম;
৭. জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি পরিবেশের ওপর হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যাপকহারে বৃক্ষনিধন, পয়ঃনিষ্কাশনে অব্যবস্থা ও বিশুদ্ধ পানির সংকট মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয় ডেকে আনছে;
জনসংখ্যা সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়ােজন বাস্তবমুখী নানা পদক্ষেপ গ্রহণ। সরকারের পাশাপাশি জনগণকেও তা বাস্তবায়নে এগিয়ে আসতে হবে। এ লক্ষ্যে –
১. অশিক্ষিত ও নিরক্ষর জনগণকে পরিকল্পিত পরিবার গঠনে উদ্বুদ্ধ করে তুলতে হবে। শিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে সমাজ থেকে ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কার দূর করতে হবে। গণসচেতনতা তৈরির জন্য জাতীয় প্রচারমাধ্যমগুলােও এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে ।
২. শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরি দক্ষতার সুযােগ সৃষ্টির মাধ্যমে জনগােষ্ঠীর গুণগত মান বাড়ানাে সম্ভব হলে জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তর করা সম্ভব।
৩. বাংলাদেশে মুষ্টিমেয় লােকের হাতে প্রচুর সম্পদ। অন্যদিকে, ব্যাপক জনগােষ্ঠী সম্পদহীন। আয়ের এ অসম বণ্টন নিরসনে অর্থনৈতিক অবস্থার প্রয়ােজনীয় পরিবর্তন সাধন করতে হবে ।
৪. বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ রােধে প্রয়ােজনীয় আইন প্রণয়ন করতে হবে।
৫. সর্বোপরি বর্ধিত জনসংখ্যার মৌলিক গুণগত উৎকর্ষ সাধনের লক্ষ্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও উন্নত জীবনযাপনের সুযােগ নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশের বিপন্ন অর্থনীতিকে সমৃদ্ধিশালী করে তুলতে হলে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ এবং জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তর করা প্রয়ােজন। এর জন্য দরকার সুনির্দিষ্ট সরকারি নীতি ও বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা। বিশেষজ্ঞদের মতে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির শতকরা নব্বই ভাগই ঘটে উন্নয়নশীল দেশগুলােতে। বিশ্বব্যাপী বিশেষ করে পিছিয়ে পড়া দেশগুলাের জনগণকে সচেতন করে তুলতে প্রতিবছর ১১ জুলাই পালিত হয় ‘ বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস’। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশও বিপুল জনসংখ্যার ভারে ভারাক্রান্ত। এ সমস্যা থেকে উত্তরণে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন কার্যক্রমের পাশাপাশি জনগণকেও সচেতন হতে হবে। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই বাংলাদেশ হয়ে উঠতে পারে সুখী ও সমৃদ্ধিশালী।
FILED UNDER : রচনা