Table of Contents
অপসংস্কৃতি ও বর্তমান যুবসমাজ রচনার সংকেত
- ভূমিকা
- সংস্কৃতি ও অপসংস্কৃতি
- বাঙালি সংস্কৃতি
- সংস্কৃতিতে অপসংস্কৃতির আগ্রাসন
- অপসংস্কৃতি ও যুবসমাজ
- উপসংহার
অপসংস্কৃতি ও বর্তমান যুবসমাজ রচনা
ভূমিকা:
অপসংস্কৃতি সংস্কৃতির নেতিবাচক রূপ সংস্কৃতি হলাে একটি জাতির স্বরূপ । এটি সম্পূর্ণ মানবীয় একটি ব্যাপার। অর্থাৎ ব্যক্তির মানবীয় গুণাবলি ও জীবনযাত্রার মধ্য দিয়ে নিজ পরিবেশ ও সমাজকে সুরুচিসম্পন্ন, সমৃদ্ধ ও উন্নত করার যে প্রচেষ্টা তার মধ্যেই সুপ্ত থাকে সংস্কৃতির চেতনা। এ চেতনার পরিপন্থি, যা মানুষের সুরুচি, বিবেক, স্বাভাবিক জীবনবােধ ও সুষ্ঠু মানস বিকাশে বাধা হয়ে দাড়ায় তারই অপর নাম অপসংস্কৃতি। সমাজে তপসংস্কৃতির প্রভাব ভয়াবহ এবং অত্যন্ত ক্ষতিকর।
সংস্কৃতি ও অপসংস্কৃতি:
মানুষের সকল চিন্তা, কর্ম ও সৃষ্টিই তার নিজস্ব সংস্কৃতির বাহন, অর্থাৎ ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব সমাজ জীবনে সংস্কৃতি হিসেবে বিকশিত হয়। সেই সমাজ যখন ঐক্যবদ্ধভাবে একটি রাষ্ট্র গঠন করে তখন সেই জাতি ও তার সংস্কৃতি সেই রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করে। আর তার প্রকাশ ঘটে দৈনন্দিন রীতিনীতি, আচার-অনুষ্ঠান, শিক্ষা-সাহিত্য, শিল্প প্রভৃতিতে। ভৌগােলিক অবস্থান, প্রাকৃতিক পরিবেশ, ধর্মীয় বিধিবিধান, নৈতিক অনুশাসন, অর্থনৈতিক অবস্থা, শিক্ষা, দর্শন ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে এক একটি সংস্কৃতি। একটি জাতির প্রাণশক্তি নিহিত থাকে তার সংস্কৃতিতে আর প্রত্যেক সংস্কৃতিরই রয়েছে নিজের মতাে করে বিকশিত হওয়ার অধিকার। অন্যদিকে, দেশে-দেশে, জাতিতে-জাতিতে সংস্কৃতির আদানপ্রদানের মধ্য দিয়েও সংস্কৃতি সমৃদ্ধ ও প্রভাবিত হয়। তবে দেশভেদে ও জাতি সংস্কৃতির উপাদান ভিন্ন ভিন্ন। যেমন পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি আর বাঙালি সংস্কৃতির মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। তাই বলে বিদেশি সংস্কৃতি মানেই অপসংস্কৃতি তা নয়। যে সংস্কৃতি মানুষের চিত্তকে কলুষিত করে, মূল্যবােধের অবক্ষয় ডেকে আনে, নৈতিকতা বিনষ্ট হয় সেটাই অপসংস্কৃতি। অপসংস্কৃতি সংস্কৃতিরই বিকৃত রূপ।
বাঙালি সংস্কৃতি:
বাঙালি সংস্কৃতির রয়েছে সুপ্রাচীনকালের ঐতিহ্য। গ্রহণ-বর্জনের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে নানা রূপ-
রূপান্তরের মাধ্যমে তা বর্তমান পর্যায়ে এসেছে। প্রাচীন বাংলার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল বাংলার পরিবেশ, প্রকৃতি, ও সমাজ জীবনকে ঘিরে । এর সাথে যােগ হয়েছিল ব্রাহ্মণ্য, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের প্রভাব দ্রাবিড়-অস্ট্রিক-ভােটব্রহ্ম প্রভৃতি জাতির মেলবন্ধনও ঘটেছিল বাঙালির প্রাচীন সংস্কৃতিতে। মধ্যযুগে এতে যােগ হলাে মুসলিম সংস্কৃতি, বিশেষ করে সুফিতত্ত্বের ভাদ্ধারা। প্রাচীন ও মধ্যযুগের পর বাঙালি সংস্কৃতির বর্তমান রূপ খানিকটা পাশ্চাত্যের প্রভাবে প্রভাবিত। বাঙালি
সংস্কৃতিতে অপসংস্কৃতির আগ্রাসন:
ড. আহমদ শরীফ তার বাঙ্গালীর সংস্কৃতি’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘চলনে বলনে, মনে-মেজাজে, কথায়-কাজে, ভাবে-ভাবনায়, আচার-আচরণে অনবরত সুন্দরের অনুশীলন ও অভিব্যক্তিই সংস্কৃতিবানতা। কিন্তু বর্তমানে বাঙালি সংস্কৃতিতে প্রবেশ করেছে অসুন্দর আর অনাচার। উনিশ শতকের শুরুতে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির ভােগবিলাসী প্রবণতা, উদ্দাম উজ্জ্বলতা আর চমক চড়াও হয়েছিল বাঙালি সংস্কৃতির ওপর। সেই অমঙ্গল আর অকল্যাণ পুরােপুরি গ্রাস করতে পারেনি বাঙালি জাতিকে। কেননা জাগ্রত বিবেকের কাছে হার মেনেছিল অশুভবােধ। পাশ্চাতা সংস্কৃতির ভালাে দিক গ্রহণ করে অশুভকে পরিত্যাগ করার প্রজ্ঞায় উজ্জীবিত হয়েছিল বাঙালি । এ শুভ দিক বাঙালি সংস্কৃতিকে করেছিল বিকশিত। কিন্তু দিনবদলের পালায় বিশ্বায়নের সুযােগে পাশ্চাত্যের অপসংস্কৃতি আবার চড়াও হয়েছে বাংলার চিরায়ত, কোমল সংস্কৃতি ওপর। বিদেশি জীবনযাপন চর্চা, পােশাক-পরিচ্ছদ, আচার-আচরণ অনুকরণ এখন বাঙালির কাছে আভিজাত্য প্রকাশের মাপকাঠি। সমাজজীবন থেকে সুস্থ বিবেকবােধ আর সততা যেন হারিয়ে যেতে বসেছে। আর বিনােদন মানে তাে উৎকট সংগীত, উদ্দাম নৃত্য, রুচিহীন চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রের কাহিনিগুলাে হিংস্রতা, শঠতা আর পৈশাচিকতায় ভরা। উগ্র ভােগবিলাসী জীবনধারা, কুৎসিত সংলাপ আর স্মৃল হাস্যরসে ভরপুর এসব চলচ্চিত্রে স্বাভাবিক জীবনবােধ একেবারেই অনুপস্থিত। আকাশ সংস্কৃতির এ অসুস্থ অনুপ্রবেশে চলছে বিনােদনের বাণিজ্যিকীকরণ। জীবন থেকে সুন্দর আর শুভবােধ যেন ক্রমশ বিলীন হয়ে যাচ্ছে। আর এ হীন মনােবৃত্তির পেছনে কাজ করছে পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদী শােষকশ্রেণি। বাংলাদেশের লুটেরা পুঁজিপতিদের সাথে রয়েছে এদের নিবিড় যােগসাজশ । সুকৌশলে এরা সুস্থ সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানতে চায়। সততা, ন্যায় আর সুন্দরের ওপর অসত্য, অন্যায় আর অসুন্দরকে বাস্তবতা বলে মেনে নেবার অপচেষ্টা চালায়। কেননা সততা, মহত্ত্ব আর বিবেকবােধ হারিয়ে গেলে সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতি বিস্তারের সুযােগ আরও ত্বরান্বিত হবে। মানুষ শােষণ আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে সােচ্চার হবে না।
অপসংস্কৃতি ও যুবসমাজ:
অপসংস্কৃতি তারুণ্যের সুন্দর বিকাশের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবক্ষয়, স্থূলতা আর
মাদকের করাল গ্রাসে নিমজ্জমান তারুণ্য অনিশ্চিত ভবিষ্যতেরই প্রতিচ্ছবি। পাশ্চাত্যের উদ্ভট পােশাক-আশাকে প্রলুব্ধ তরুণ সমাজ কথাবার্তায়, আচার-আচরণেও হারাতে বসেছে বাঙালি ঐতিহ্য। পাশ্চাত্যের ভােগবিলাসী জীবনধারায় তারা মােহান্ধ । বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলােতেও লেগেছে অপসংস্কৃতির ছোঁয়া । বিকৃত বাংলায় উপস্থাপনা, ইংরেজি শব্দের বহুল ব্যবহার, উদ্ভট পােশাক-পরিচ্ছদ—বাঙালি সংস্কৃতির বিন্দুমাত্র ছোঁয়া নেই তাতে। নিজের স্বকীয়তা, মূল্যবােধ আর বিবেক বিসর্জন দিয়ে অপসংস্কৃতির এ বিলাসী স্রোতেই অবগাহন করছে আজকের তারুণ্য। যে বাঙালি তরুণ সমাজের রয়েছে অন্যায় আর অনৈতিকতার ব্রুিদ্ধে সংগ্রামের অসামান্য ঐতিহ্য, অপসংস্কৃতির কবলে পড়ে সেই তরুণ সমাজই আজ অনৈতিকতার অতল গহ্বরে হারিয়ে যেতে বসেছে।
উপসংহার:
ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলন, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণআন্দোলন, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরােধী আন্দোলন ইতিহাসের সব প্রেক্ষাপটেই রয়েছে বাঙালির আত্মত্যাগ, বীরত্বগাথা, যুবসমাজের অবদান। আর এ ঐতিহ্যের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে বাঙালি সংস্কৃতি। বাঙালি সংস্কৃতির লক্ষ্যই হলাে দেশের মানুষের আর্থসামাজিক সংস্কৃতি ও মনােজাগতিক মুক্তি। এর ওপর অপসংস্কৃতির বিরূপ আগ্রাসন মানেই বাঙালি ঐতিহ্যকে পঙ্গু করে দেওয়া, সমূলে বিনষ্ট করা। তাই এর হাত থেকে তরুণ প্রজন্ম ও সমগ্র জাতিকে রক্ষা করার দায়িত্ব সকল বাঙালির। বিশ্বের তাবৎ সংস্কৃতির ভালাে দিক গ্রহণ ও মন্দ দিক বর্জন করেই আমাদের সংস্কৃতিকে পুষ্ট করতে হবে। সংস্কৃতিবান জাতি হিসেবে অবশ্যই আমাদের সকলের লক্ষ্য হওয়া উচিত অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানাে।