একটি টাকার আত্মকাহিনি রচনা লিখন
আমি একটি পুরােনাে একশ টাকার নােট। নম্বর শপ ৭৩৭৮০৭৪। নীলচে ধূসর আমার গায়ের রং। এক পিঠে স্মৃতিসৌধের ছবি, আরেক পিঠে যমুনা সেতু। এক পাশে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিল, অন্য পাশে গভর্নরের স্বাক্ষর। একটু ওপরের দিকে লেখা চাহিবামাত্র ইহার বাহককে দিতে বাধ্য থাকিবে। অধিকাংশ সময় দু ভাঁজ করা অবস্থায় থাকার কারণে আমার মাঝ বরাবর একটা দাগ বসে গেছে। তবে একটু পুরােনাে হলেও আমার গায়ে কোনাে ময়লা দাগ নেই। ভাগ্যিস দু টাকা হয়ে জন্ম নিইনি, এরা সবাই হয় ময়লা, না হয় ছেড়া।
টাকা ছাপার মেশিন থেকে বের হয়ে এ পৃথিবীতে আমার বয়স আট বছর । এ আট বছরে শত শত মানুষের আঙুলের ছাপ বহন করেছি আমি। চাকরিজীবী, গৃহিণী, কিশাের, দোকানদার, ব্যবসায়ী, অ্যাকাউন্ট্যান্ট, ছিনতাইকারী, ক্যাডার আরও কত
রকম মানুষের হাত বদলে পার হয়েছে এ বছরগুলাে। কখনাে মানিব্যাগে, কখনাে ছােট পার্সে, কখনাে আলমারির কোনাে গুপ্ত ড্রয়ারে । এক শ টাকার নােট হিসেবে আমি বেশ দামি । তাই সবখানেই আমার কদর । আমার চেয়ে বেশি গুরুত্ব কেবল পাঁচ শ টাকার নােটের । ওহ না। এখন তাে আবার হাজার টাকার নােটও বের হয়েছে। জিনিসপত্রের দাম যত বাড়ছে, আমাদের মূল্য তত কমে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে খুব তাড়াতাড়িই পাঁচ-দশ টাকার নােট বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
মূল্য কমলেও আমাকে নিয়ে মানুষের চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলেছে। আমাদের গােনার সময় মানুষের চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আমাদের আগমনের আশায় তারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। কেউ কেউ আরও টাকা পাওয়ার উদ্দেশ্যে অসং পথ বেছে নেয় । কেউ জোর করে আমাদের হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। এমনি এক ভয়ংকর ঘটনার সাক্ষী হয়েছিলাম আমি। তখন আমি একজন চাকরিজীবী লােকের পকেটে। তিনি রাতে এক নির্জন গলির ভেতর দিয়ে বাসায় ফিরছিলেন। হঠাৎ তাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরল কয়েকজন ছিনতাইকারী। সবার হাতেই ছুরি। মানিব্যাগ আর ঘড়ি ছিনতাই করে নিয়ে গেল তারা। ভাগ্যজোরে লােকটার কোন ক্ষতি হয়নি। মানুষ তাে আমাদের কারণে প্রাণ নিতেও দ্বিধা করে না। আমি কারও প্রাণহানির কারণ হতে চাই না। এরপর অবশ্য এমন পরিস্থিতির মুখােমুখি হতে হয়নি আমাকে।
ছিনতাইকারীদের ভয়ে একবার এক তরুণ আমাকে তার মােজার নিচে লুকিয়ে রেখেছিল। আমি বেশ বিরক্ত হয়েছিলাম। টাকার ক্ষমতা যেমন অনেক, তেমনি বিড়ম্বনাও অনেক। তেমনই এক বিড়ম্বনা হচ্ছে আমার গায়ে অহেতুক লিখে রাখা । অনেকেই কলম দিয়ে নােটের ওপর নানা কিছু লিখে রাখে নিজের নাম, জায়গার নাম, মােবাইল নম্বর, উদ্ভট চিহ্ন। ভীষণ বিরক্তিকর। তাদের কারাে কপালে এসব লিখে দিলে তাদের কি খুব ভালাে লাগবে? আরও বিরক্ত লাগে যখন বিভিন্ন মানুষের ময়লা হাত ঘুরে আমি নিজেও ময়লা হয়ে যাই । মানুষ নিজেই আমাকে ময়লা করে, আবার নিজেরাই ময়লা নােট নিতে চায় না। যেন আমার দোষেই নােটটা ময়লা। কী আর করা! আমার তাে আর গােসল করার উপায় নেই। আবার অনেকে নােটের মাঝখানে একটু ছিড়ে গেলে আমাদের ছেড়া নােট’ বলে বাতিল করে দেয়। বােঝে না, অতটুকু ছিড়লে কোনাে সমস্যা হয় না।
আমার সবচেয়ে স্মরণীয় অভিজ্ঞতা হলাে ব্যাংকের ভল্টে থাকা আর এটিএম বুথের মেশিন দিয়ে বের হয়ে আসা। কয়েক বছর আগে এক ব্যবসায়ী আমাকেসহ মােট চার লক্ষ টাকা ব্যাংকে জমা করলেন। আমি পৌছে গেলাম একটা বিরাট অন্ধকার ইঘরে। সেখানে সারি সারি টাকার বান্ডিল, নতুন নােটের ঘ্রাণ । ওখান থেকে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলাে একটা ছােট লােহার বাক্সে। তারপর কয়েক ঘণ্টা পর একটা সূক্ষ্ম ফাকের মধ্য দিয়ে আমাকে ঢুকিয়ে দেয়া হলাে। দেখলাম আমি খুব মসৃণ সমতল কিছু একটাতে শুয়ে আছি এবং সামনের দিকে এগুচ্ছি চারদিকে অন্ধকার। হঠাৎ আলাের মধ্যে এসে পড়লাম এবং পৌছে গেলাম কারাে হাতে। এ হচ্ছে এটিএম মেশিনে আমার প্রথম ভ্রমণ ।
আমি বুঝতে পারি আমাদের জন্যেই এ দেশে দুই শ্রেণির মানুষের মধ্যে বিরাট ব্যবধান। আমি নিজেই এ ব্যবধানের সাক্ষী। কোনাে এক রােজার ঈদে বারাে বছর বয়সের ছােট্ট একটা ছেলের হাতে সালামি হিসেবে দেয়া হয় আমাকে। দু মাস পর সেই আমিই ঘটনাচক্রে চলে যাই এক কাজের বুয়ার হাতে। আমি ছাড়াও তার কাছে ছিল আর চারটা এক শ টাকার নােট । এ ছিল তার সারা মাসের উপার্জন । অথচ আমি নিশ্চিত সেই ছােট্ট ছেলেটা ঈদের দিনেই পেয়ে গিয়েছিল পাঁচ শ টাকা । কেউ খরচ করে বিলাসিতায় আর কেউ দু তিন বেলা খাবার জোগাড় করতে । সময়ের সাথে সাথে এ ব্যবধান যেন আরও বাড়ছে।
আজকাল আমাদের নানা বিশেষণে বিশেষায়িত করা হয়। কালাে টাকা’, ‘সাদা টাকা’, ‘জাল টাকা’ ইত্যাদি। আমি জানি, জাল টাকার অস্তিত্ব আছে | মাঝে মাঝে আমাকেও আলাের নিচে রেখে যাচাই করে দেখা হয় আমি আসল না নকল। তখন আমি বেশ অপমানবােধ করি। কালাে টাকা’ শব্দটি ব্যবহার করলে আমার খুব রাগ হয়। অসৎ উপায়ে টাকা উপার্জন করে মানুষ, আর সেই উপার্জিত টাকাকে কালাে বলে অপমান করা হয় আমাদের। টাকাকে ধিক্কার না দিয়ে বরং অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়েও যারা অবৈধভাবে আরও টাকার মালিক হওয়ার ফন্দি আঁটছেন তাদের শনাক্ত করা উচিত।
আমার প্রতি মানুষের বাড়তি লােভ দেখে কেমন যেন অস্বস্তি হয়। এক টুকরাে কাগজের মােহ যেন মানুষের জীবনটাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের চিন্তাচেতনা, শিক্ষা-শ্রম যেন এ কাগজের পেছনেই লগ্নি করা। সাফল্যের মাপকাঠি হিসেবে গণ্য করা হয় এ কাগজকেই । মানুষ হয়ে ওঠে আরও লােভী, বিবেকশূন্য ও আবেগহীন । কিন্তু কেন এত নিচে নেমে যাওয়া এ প্রশ্নের উত্তর আমি খুঁজে পাই না।
আমার আয়ু কমপক্ষে আরও কয়েকটি বছর দু টাকার নােটের মতাে জীর্ণ-শীর্ণ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা নেই আমার। কারণ আমার মূল্য একটু বেশি । একদিন হয়তাে মানুষ বুঝতে পারবে অতিরিক্ত টাকা সমস্যার মূল কারণ। আর তখন টাকার পেছনে উন্মাদের মতাে ছুটবে না। কিন্তু সেই সুদিন কবে আসবে আমার জানা নেই। তার আগ পর্যন্ত আমাকে এভাবেই মানুষের অন্যতম আকর্ষণ হয়ে বেঁচে থাকতে হবে। হয়ত তা অনন্তকাল।