একটি শীতের সকাল রচনা
নবান্নের উৎসব শেষ হতে না হতেই উত্তরের হাওয়ায় ভর করে শীত নামে বাংলার প্রকৃতিতে। শীতের সকাল, শীতের প্রকৃতির রূপ এসব আমি বইতেই পড়েছি। নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করার অবকাশ হয়নি কখনাে। কেননা শহুরে জীবনে ভবিষ্যৎ গড়ার লক্ষ্যে আমার সে সুযােগ আসেনি আগে। যখন এলাে তখন আমার চেনা জগৎটাই পাল্টে গেল । আমার ছােট মামা এবং মামার বন্ধু স্বপন দু জনই সরকারি কর্মকর্তা। স্বপন মামা সম্প্রতি বদলি হয়েছেন সিলেটে। স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হবার আগে মামা আমায় লােভ দেখালেন মন দিয়ে পড়লে এ শীতে সিলেটে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া হবে। আমি প্রচুর লেখাপড়া করে পরীক্ষা দিলাম । স্কুল ছুটি হলাে। শুক্র, শনি সরকারি বন্ধ। সেভাবে মিলিয়ে ডিসেম্বরের এক বৃহস্পতিবার আমি আর মামা রওনা হলাম সিলেটের পথে । স্বপন মামা অস্থায়ীভাবে সিলেট সর্কিট হাউজে থাকেন। আমরাও সেখানেই উঠলাম। সিলেটে পৌছতে রাত হয়ে গেল। আগে থেকেই ঠিক করা ছিল পরদিন ভােরে জাফলং যাব।
উত্তেজনায় রাতে আমার ঠিকমতাে ঘুমই হলাে না। ভাের হওয়ার কিছু আগেই লেপের উষ্ণতা ছেড়ে বেরিয়ে এলাম বারান্দায়। সিলেট সার্কিট হাউজটা সুরমা নদীর তীর ঘেঁষে। নদীর ওপরে ব্রিটিশদের নির্মিত বিশাল নান্দনিক সেতু। গভীর ঘন কুয়াশায় চারদিক অস্পষ্ট। সেতুর ওপরে সড়কবাতিগুলাে তখনও জ্বলছে। গত রাতে দেখা সুরমা নদী হারিয়ে গেছে ঘন কুয়াশার অন্তরালে । প্রচণ্ড ঠান্ডায় আমি কাপছিলাম।
বারান্দায় বেশিক্ষণ দাঁড়ানাে গেল না। শরীরে কাঁপন ধরে গেছে । কেন যে ছাই গরম কাপড় ছাড়া বাইরে গেলাম। লেপ গায়ে দিয়েও সেই কাঁপুনি আর থামে না। শীতের সকালের এইতাে শুরু।
সিলেট শহর থেকে জাফলং দেড় ঘণ্টার পথ। আমরা রওনা দিলাম সকাল সাতটায়। ছােট মামা, স্বপন মামা আর আমি। সকালে নাশতা এবং চা পর্ব সেরে নিয়েছি আগেই। শীতের কুয়াশায় ঢাকা-সিলেট শহরে তখনও সূর্য ওঠেনি। চারদিকে ধূসর পাহাড়ের মতাে জমে আছে কুয়াশা। শিশিরে মাটি ভিজে আছে, যেন বৃষ্টি হয়েছে। আমাদের তিনজনেরই গায়ে ভারী। সােয়েটার, মাথায় কানটুপি। ডিসি অফিস থেকে পাওয়া পিকআপটা সার্কিট হাউজের সীমানা ছাড়িয়ে উঠে এলাে প্রধান। সড়কে। কুয়াশার দাপট খানিকটা কমে এসেছে। বইছে কনকনে হাওয়া। ছুটির দিন। কিন্তু রিকশাওয়ালা, ঠেলাওয়ালা, মুটে এদের তাে ছুটি নেই। এ কনকনে শীতে তাদের কারাে কারাে গায়ে হালকা শীত পােশাক, কারাে গায়ে তাও নেই। আমার খুব কষ্ট হলাে। জীবনসংগ্রাম কত কঠিন, বাস্তবতা কত নির্মম!
সুরমা ব্রিজটা পেরুনাের সময় নদীর দেখা মিলল নদীতে পানি অনেক । নদীর জলের ওপর দিয়ে ঠিক সমান্তরালভাবে ভেসে চলেছে কুয়াশার নদী— অনেক দূরে একটি বিন্দুতে মিলিত হয়েছে যেন। আমাদের গাড়ি যিনি চালাচ্ছিলেন তার নাম মনােরঞ্জন। বয়স হয়েছে, কিন্তু দক্ষ হ’ত। একটা লাল রঙের মাংকি টুপি পরেছেন। আমাকে ডাকছিলেন খােকাবাবু বলে। আমার যে একটু একটু রাগ হচ্ছিল না তা নয়। ছােট মামা আর স্বপন মামা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি রােমন্থনে ব্যস্ত। আমি বন্ধ জানালা দিয়ে বাইরে দেখছিলাম। কুয়াশায় জানালার কাচ মাঝে মাঝে ঘােলাটে হয়ে যাচ্ছে। মনােরঞ্জন কাকু একটু পরপর ওয়াইপার চালাচ্ছেন। একসময় আমরা লােকালয় পেরিয়ে এলাম । রাস্তার দু ধারে ফসলহীন শূন্য মাঠ, অফুরান ফঁকা জমি, পাতাঝরা গাছ। যতদূর দৃষ্টি যায়, কুয়াশার চাদর ঢাকা বিষন্ন প্রকৃতির সময় যেন এক জায়গায় স্থির হয়ে আছে। কিন্তু ঘড়ির কাটা সকাল আটটার ঘরে। একটা খুপড়ি মতাে চায়ের দোকানের সামনে গাড়ি থামানাে হলাে। দোকানের সামনে দুটো বে পাতা। দোকানের পেছনটায় চোখে পড়ল কিছু ফসলি জমি পাকা ধান। হলুদ সরিষা খেত। হেমন্তের শেষে যে ধান। পেকেছে তা এখন ঘরে তােলার সময়। এ শীত সকালে কনকনে ঠান্ডায় মাঠে কাজ করছেন কেউ কেউ, পাকা ধান কেটে নিচ্ছেন। আমার মনে হলাে, এমন ছুটির দিনে আমরা শহরে সচ্ছল, আরামপ্রিয় মানুষরা নরম বিছানায় লেপ-কম্বলের উষ্ণতায় আচ্ছন্ন থাকি । আর এ কৃষকদের কষ্টের ফসলই আমাদের অন্ন জোগায়। খুপড়ি দোকানি আমার বয়সি । অভ্যস্ত হাতে দ্রুত আমাদের তিন কাপ চা বানিয়ে দিল। এর সাথে কথা হলাে । ওর নাম কাশেম। ক্লাস ফোর পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। আগে ওর বাবা দোকান চালাত। বাবা হঠাৎ মারা যাওয়ায় কাসেম এখন দোকানে বসে। বিল মিটিয়ে আমরা যখন গাড়িতে উঠছি, কাশেমের চোখে তখন অদ্ভুত বিষন্নতা।
তখনও রােদ ফোটেনি। কুয়াশা ভেদ করে গাড়ি আবার ছুটল দু-একটা বাগানঘেরা বাড়ি চোখে পড়ল, নিস্তব্ধ । বাগানে ফুটে রয়েছে গাঁদা, ডালিয়া, কসমসসহ নানা শীতের ফুল। তবে এদিকে কোনাে খেজুর গাছ চোখে পড়ল না। আমার খুব ইচ্ছে ছিল শীত সকালে খেজুরের রস খাওয়ার । ঢাকায় মাঝে মাঝে বিক্রি হয়। তবে তাতে খাঁটি রসের স্বাদ থাকে না।
চলতে চলতে হঠাৎ যেন আমি অন্য একটা রাজ্যে চলে এসেছি। দু ধারে বিশাল বিশাল পাহাড়ের সারি, রাস্তাটাও যেন পাহাড়েই মিশে গেছে। ধীরে ধীরে কুয়াশা কাটতে শুরু করেছে। মনােরঞ্জন কাকু জানালেন, পাহাড়গুলাে সব ভারতে পড়েছে। ওপারে সুউচ্চ পাহাড়ের টানা প্রাচীর, এপারে সমতল বাংলাদেশ। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের এত বড় পাহাড় আমি এর আগে কখনাে দেখিনি। পাহাড় চূড়ায় একটু যেন সােনালি রং। কুয়াশা ভেদ করে সূর্য উকি দিচ্ছে। পাহাড়ের গায়ে মাঝে মাঝে সরু ঝরনাধারা। বর্ষায় নাকি জলের ধারা আরও বেড়ে যায়।
সারি সারি পাহাড়ের সীমানা ছাড়িয়ে আমরা জাফলং এসে পৌছলাম। জাফলং পড়েছে সিলেটের গােয়াইনঘাট উপজেলায়। গাড়ি থেকে নামতেই সােনালি রােদের পরশ। কিন্তু হিমেল বাতাস বয়েই চলেছে। এখানে অনেক লােকের ভিড়। ছােট্ট যে নদীটি এঁকেবেঁকে বয়ে চলেছে তার নাম পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ জলের নিচে কত না রং-বেরঙের পাথর। এখানে কারাের যেন শীত নেই। চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। কেউ নদী থেকে পাথর তুলছে, কেউ নৌকা করে যাত্রী পারাপার করছে। কেউ কেউ আবার বালির মাটি খুঁড়ে বের করে আনছে কয়লা। সকলেই নিম্নআয়ের। নারীরাও এসব কঠিন কাজ করছেন। পিয়াইন নদীর জলে তিরতির করে কাপছে কাঁচা সােনা রােদ। ছােট্ট সরু নদী। আমরা একটা নৌকায় এপার থেকে ওপারে গেলাম। কোথাও ঝালমুড়ি, কোথাও বড়ইয়ের আচার, কোথাও বাদাম বিক্রি হচ্ছে। এখানেও জীবন কত কঠিন। শীত সকালে বিলাসিতা করার সময় কোথায় এদের! দূরে একটা ঝুলন্ত ব্রিজ চোখ পড়ল। ওটা ভারতের সীমানায় ।
আলাদা করে কোনাে সীমানা টানা নেই। একই শীত সকাল, একই কুয়াশা, একই রােদের পরশ, তারপরও যােজন যােজন। দূরত্ব। বিএসএফ সদস্য দাড়িয়ে আছে পাহারায় । কুয়াশা প্রায় কেটে গেছে, কিন্তু ঠান্ডা কমেনি। প্রচুর হাঁটাহাঁটি করায় শরীরে খানিকটা উষ্ণতা এলাে। সবশেষে শিশিরভেজা পানের বরজ, সুপারি আর কমলালেবুর বাগান পেরিয়ে গেলাম আদিবাসী খাসিয়া পল্লিতে। অপূর্ব সুন্দর সেই পল্লির নিকানাে উঠোনে তখন সাদা রােদেরা খেলা করছে।
আরো দেখুন-
রচনা: শীতকাল
রচনা: অতিথি পাখি / পরিযায়ী পাখি
অনুচ্ছেদ: শীতের সকাল