Table of Contents
নদীমাতৃক বাংলাদেশ রচনার সংকেত
- ভূমিকা
- মানব সভ্যতায় নদনদীর প্রভাব
- বাংলাদেশের নদনদী
- বাংলাদেশের রূপ-বৈচিত্র্যে নদনদী
- বাংলাদেশের জনজীবনে নদনদীর ইতিবাচক প্রভাব
- বিরূপ প্রভাব
- বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নদীর ভূমিকা
- বাংলা সংস্কৃতিতে নদনদীর প্রভাব
- উপসংহার
নদীমাতৃক রচনা লিখন
ভুমিকা:
প্রকৃতির বিচিত্র দানে অপরূপ শােভায় সজ্জিত হয়েছে বাংলাদেশ। এ দেশের অবস্থান ঠিক সমতল নয় বরং সাগরপৃষ্ঠ থেকে ক্রমশ উঁচুতে চলে গেছে। তাছাড়া এটিই পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ। বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন এ দেশটি প্রাকৃতিক রূপ-বৈচিত্র্যে অনন্য। এদেশে রয়েছে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। ভৌগােলিক স্বাতন্ত্র্য দেশটিকে যেমনভাবে বিশ্ব মানচিত্রে বিশেষভাবে পরিচিত করেছে তেমনি এ দেশের অধিবাসীদের আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও সুদূরপ্রসারী প্রভাব রেখে চলেছে। বাংলাদেশের আড়াআড়ি অবস্থানের ফলে হিমালয় থেকে উৎপন্ন জলের ধারা তার স্বভাবজাত ধর্ম অনুযায়ী এদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। পথিমধ্যে বাংলা নামের এ জনপদকে সমৃদ্ধ করেছে অসংখ্য নদনদী দিয়ে; বাংলা হয়েছে নদীমাতৃক বাংলাদেশ।
মানবসভ্যতায় নদনদীর প্রভাব:
সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকে মানুষের জীবনযাত্রার সাথে নদীর অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। যুগে যুগে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে, মনীষীদের লেখায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে নদনদীর স্তুতি। সভ্যতার বিকাশের ক্ষেত্রে নদীর ভূমিকার দিকটি বিবেচনা করে ওয়ার্ল্ড ওয়াচ ইনস্টিটিউটের প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট সান্ড্রা পােস্টাল বলেছেন- মানবসভ্যতার ইতিহাস পানির (নদী ও সাগর) অবদান ছাড়া আলােচনা করা অসম্ভব। বস্তুত, নদীর অবদানেই প্রাণ পেয়েছে মানবসভ্যতা। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতা যেমন— অ্যাসেরীয়, ক্যালডীয়, সিন্ধু, চৈনিক প্রভৃতি থেকে শুরু করে আজকের আধুনিক সভ্যতাগুলাের অধিকাংশই বিভিন্ন নদীর তীরবর্তী অঞলে গড়ে উঠেছে। এ সত্যটি আমাদের দেশের জন্য সমানভাবে প্রযােজ্য।
বাংলাদেশের নদনদী:
বলা হয় তেরােশত নদীর দেশ বাংলাদেশ। হাজারও নদী জালের মতাে ছড়িয়ে রয়েছে পুরাে দেশ জুড়ে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র এগুলাের মধ্যে প্রধান। এছাড়াও তিস্তা, সুরমা, কুশিয়ারা, বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, মধুমতি, করতােয়া, কর্ণফুলী, গড়াইসহ অসংখ্য ছােট বড় নদী আছে এ দেশে। প্রতিটি নদীরই রয়েছে স্বাতন্ত্র। বাংলার জনপদগুলােকে গভীর মমতায় জড়িয়ে রেখেছে এসব নদী ।
বাংলাদেশের রূপ-বৈচিত্র্যে নদনদী:
বাংলাদেশের বৈচিত্র্যময় রূপময়তার বিশাল একটি অংশ জুড়ে রয়েছে নদী। নদীর বুকে জলের ছন্দময় চলা, পালতােলা নৌকার সৌন্দর্য সৌন্দর্যপিপাসু মানুষের নজর কাড়ে। শরতে নদীর তীরে দেখা মেলে শুভ্র কাশফুলের। নানা ধরনের জীবজন্তুতে নদীর তীর থাকে পরিপূর্ণ। বর্ষায় নদীর দুকূল ছাপিয়ে জলরাশি প্লাবিত করে চারপাশকে। নদীর এমন রূপ বড়ই মােহনীয়। সব মিলিয়ে নদীর অবদানে বাংলাদেশের প্রকৃতি হয়েছে ঐশ্বর্যময়।
বাংলাদেশের জনজীবনে নদনদীর ইতিবাচক প্রভাব:
আবহমানকাল ধরেই বাংলার মানুষের জীবন-জীবিকার সাথে নদীর রয়েছে গভীর মিতালি। অস্ট্রিক জাতির লােকেরা পূর্ব ও মধ্য ভারতে প্রথম কৃষিকাজ শুরু করে। এর ওপর ভিত্তি করেই তারা সংঘবদ্ধ হয়ে সুসভ্য জীবনের সূত্রপাত করে। তারা ধান, পান, কলা ও নারকেল চাষ করত যা আজও বাংলার সংস্কৃতিত গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। এ সবকিছুর মূলেই রয়েছে নদীর অবদান। এর বাইরেও প্রাচীনকাল থেকে ভাত-মাছ। বাংলার মানুষের প্রধান খাদ্য হওয়ার মূল কারণ এদেশের নদীমাতৃকতা। ধান চাষের প্রধান উপকরণ হচ্ছে পানি। আর প্রাগৈতিহাসিককাল থেকে চাষাবাদের জন্য এ অঞ্চলে পানির প্রধান চাহিদা মিটিয়েছে নদী। অন্যদিকে, আমাদের নদ- নদীগুলাে সারাবছর ধরে জোগান দিচ্ছে প্রয়ােজনীয় মাছের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। পদ্মা-মেঘনার ইলিশের রয়েছে বিশ্বজোড়া খ্যাতি। নদীর আশীর্বাদ নিয়ে জেলে সম্প্রদায় যুগ যুগ ধরে টিকে আছে। তাছাড়া যােগাযােগ ও পণ্য পরিবহনেও নদীপথ অত্যন্ত জনপ্রিয়।
বিরূপ প্রভাব:
নদীর বৈচিত্র্যময় আচরণের কারণে জনজীবনেও দেখা দেয় নানা পরিবর্তন। নদী থেকে যে মাছ পাওয়া যায় তা আমাদের আমিষের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সাহায্য করছে। চর দখল সংস্কৃতিও নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। নদীভাঙনের শিকার মানুষগুলাে শহরমুখাে হয়ে তৈরি করেছে বস্তি সমস্যা, বাড়াচ্ছে সামাজিক সংকট। পদ্মা ও যমুনার ভাঙনে গৃহহারা মানুষ দলে দলে ভিড় করছে শহরগুলােতে। বদলে যাচ্ছে শহরের জনসংখ্যার অনুপাত। নদীর আরেকটা বিরূপ প্রভাব হলাে বন্যা। আমাদের দেশে প্রায় প্রতি বছরই ফলে আঘাত হানে বন্যা। এর ফলে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় ।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নদীর ভূমিকা:
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নদীর ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। বাংলার মানুষের যােগাযােগের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে নদী। নদীভাঙন ও বন্যার কারণে ঘরবাড়ি হারানাে কর্মহীন মানুষ শহরে ভিড় করায় শহরে সুলভ মূল্যে শ্রম মিলছে। পানীয় জলের সবচেয়ে বড় উৎস নদী। নদী থেকে প্লাবনের সাথে ভেসে আসা পলি এদেশের মাটিকে করেছে উর্বর। সুলভে শ্রমিক প্রাপ্তির সামাজিক পরিবর্তনের প্রভাব থেকে বাদ যাচ্ছে না শহরের অর্থনৈতিক কাঠামােও। সুভ শ্রমিকের উপস্থিতি শিল্পনির্ভর শহরের উৎপাদনক্ষেত্রে যে প্রভাব রাখছে, তা নতুন ধরনের সামাজিক শ্রেণীকরণ, জনসংখ্যার বণ্টন ও আর্থসামাজিক পরিমণ্ডল তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এভাবে নদী বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনাচারে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে চলেছে।
বাংলা সংস্কৃতিতে নদনদীর প্রভাব:
বাংলা ও বাঙালির সংস্কৃতি প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে নদীকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। সংস্কৃতিকে যদি সমাজের প্রতিচ্ছবি ধরা হয়, তাহলে সমাজের যত বিষয় রয়েছে এর প্রায় সবই নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। এদেশের যে সংস্কৃতি নানা ভাঙা গড়ার মধ্য দিয়ে বর্তমান অবস্থায় এসে পৌছেছে তা প্রধানত কৃষিজীবী সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে নদী। নদীর প্রভাব উঠে এসেছে এ অঞ্চলের মানুষের মুখের ভাষায়ও। তাছাড়া প্রবাদ প্রবচন, প্রতিদিনের বাক্যালাপ, পারিবারিক-সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়ােজন থেকেও বাদ যায় না নদী। এমনকি বাংলা সাহিত্যের বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে এদেশের বিভিন্ন নদনদী। নদীকেন্দ্রিক জীবন-সংস্কৃতির কারণেই এদেশে ভাটিয়ালি ও সারি গানের বিপুল সম্ভার গড়ে উঠেছে। এছাড়া বাংলা সংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ পােশাক-পরিচ্ছদও বহুলাংশে নদী দ্বারা প্রভাবিত। নদীকেন্দ্রিক কৃষি ব্যবস্থায় কাজে সহায়ক ভূমিকার জন্য লুঙ্গি ও গামছা পেয়েছে একচেটিয়া জনপ্রিয়তা। নদী এ অঞলের পারস্পরিক সম্পর্ক ও সমাজ বিনির্মাণেও অন্যতম ভূমিকা পালন করে আসছে সাগরতীরবর্তী সভ্যতায়। কৃষিকাজের ব্যবহার সীমিত বলে মানুরে মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা কম। অন্যদিকে, বাংলায় নদীকেন্দ্রিক কৃষি ব্যবস্থায় পানি সেচের প্রয়ােজনে দলবদ্ধভাবে কাজ করতে হয়। এতে করে মানুষ দলগত চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়। এদিক থেকে। দেখলে আমাদের সামাজিক বন্ধন, দলবদ্ধ হয়ে কাজ করার প্রবণতা, দেশপ্রেম, রাষ্ট্রচিন্তা থেকে শুরু করে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণববিষয়কে নানা দিক থেকে প্রণােদিত করেছে নদী ।
উপসংহার:
শরীরের রক্তধারার মতােই যেন বাংলাদেশের নদী এদেশকে বাঁচিয়ে রেখেছে। সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা করে তুলেছে এদেশকে। পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে অনেক নদী হারিয়েছে তার যৌবন। অনেক নদীই আজ লুপ্তপ্রায়। অথচ একসময় নদী তীরবর্তী সভ্যতা হিসেবেই এদেশে জনপদ গড়ে উঠেছিল। কালের প্রভাবে নদীগুলাে জৌলুস হারালেও আজ অবধি সেগুলাে নানাভাবে এদেশের প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছে। আর তাই নদী না বাঁচলে যে বাংলাদেশ বাঁচবে না তাতে কোনাে সন্দেহ নেই। এজন্য বাংলার প্রকৃতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির স্বার্থেই নদীগুলােকে রক্ষা করতে সবাইকে সচেষ্ট হতে হবে।