Table of Contents
নৌকায় ভ্রমণে অভিজ্ঞতা বা নৌকায় ভ্রমণ রচনার সংকেত (Hints)
- ভূমিকা
- নৌকায় ভ্রমণের কারণ
- ভ্রমণের পূর্বপ্রস্তুতি
- ভ্রমণের যাত্রাপথ
- ভ্রমণকালীন নদীর দু’ধার
- ভ্রমণকালীন নদীর দৃশ্য
- নদীতে সূর্যাস্ত
- নদীতে রাত্রিকালীন সময়
- ভ্রমণের সমাপ্তি
- উপসংহার
নৌকায় ভ্রমণে অভিজ্ঞতা বা নৌকায় ভ্রমণ রচনা
ভূমিকা:
বিচিত্র এ পৃথিবীর চারদিকেই রয়েছে অজস্র সৌন্দর্যের উপকরণ। এ সৌন্দর্য আমাদের মনকে পুলকিত করে এবং জীবনকে করে গতিশীল । প্রকৃতির অফুরন্ত ভাণ্ডার চারিদিকে রয়েছে পর্বত, অরণ্য, সমুদ্র ও নদী। এদেশকে নদী মায়ের মতােই আঁচলে আঁকড়ে ধরে রেখেছে; তাই আমরা ‘নদীমাতৃক বাংলাদেশ’ বিশেষণটি ব্যবহার করি। এদেশের ছােটো-বড় অগণিত নদীতে ছুটে চলে হাজারাে নৌকা। তাতে প্রতিদিনই লাখাে মানুষ পারাপার করে। জেলেদের জীবিকার অবিচ্ছেদ্য অংশ এই নৌকা। পালতােলা নৌকা যেন জীবনের প্রতীক হয়ে ছুটে চলে নদীর বুকে। এই নৌকাতে বেড়ানাে আমার দীর্ঘদিনের চাওয়া— অবশেষে তা পূর্ণ হলাে ।
নৌকায় ভ্রমণের কারণ:
গ্রামের বাড়ি রাজশাহী জেলার চারঘাটে হওয়ায় ছােটো থেকেই চোখের সামনে প্রমত্ত পদ্মা দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল নজরুলের অসাধারণ এক গান—‘পদ্মার ঢেউ রে; মাের শূন্য হৃদয় পদ্ম নিয়ে যা
যারে।’ এ গানই যেন পদ্মার বুকে আমাকে টেনে নিয়ে আসত। মন চাইত ছােট্ট একটা নৌকা নিয়ে পদ্মার বুকে হারিয়ে যাই। কিন্তু বয়স কম থাকায় আর সাঁতারে কাঁচা হওয়ায় পদ্মায় নৌকা ভ্রমণের সুযােগ আমার হয়নি। অবশেষে এসএসসি পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর বাড়ির সবাইকে বুঝিয়ে আমি পদ্মায় নৌকা ভ্রমণের অনুমতি পাই। অপেক্ষা করতে থাকি নির্দিষ্ট সেই দিনের জন্যে।
ভ্রমণের পূর্বপ্রস্তুতি:
এসএসসি পরীক্ষায় পর দীর্ঘ অবসরই ছিল নৌকা ভ্রমণের আদর্শ সময়। এ সময় নদীতে তেমন স্রোত থাকে না; তাছাড়া মাছ ধরার তেমন ভিড়ও থাকে না। ভ্রমণের আগের দিন আমি ভীষণভাবে উফুল্ল ছিলাম; যদিও বাড়ির সবাই বেশ চিন্তায় ছিল। তাদের চিন্তা নিরসন করতে আমার গ্রামের বাড়ির সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু সােহেলকে নিয়ে নিলাম। সােহেল ছিল সুস্বাস্থ্যের অধিকারী; তাছাড়া ও খুব ভালাে সাতার জানত। ওকে সঙ্গে নেয়াতে বাড়ির সবাই বেশ আশ্বস্ত হলাে । প্রচুর শুকনাে খাবার, ফ্লাক্স ভর্তি চা, একটি ডিজিটাল ক্যামেরা, মাথায় দেয়ার ছাতাসহ একটি বড় ট্রাকের টিউব নিয়ে নিলাম যদি কোনাে দুর্ঘটনায় পড়ি টিউবটি আমাদের ভেসে থাকতে সাহায্য করবে।
ভ্রমণের যাত্রাপথ:
চারঘাটের খেয়া পারাপার ঘাট থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হলো। কাশেম চাচা এ অঞ্চলের খুব অভিজ্ঞ ও
নির্ভরযােগ্য একজন মাঝি। তার নৌকা আমরা ভ্রমণের জন্যে ঠিক করেছিলাম । চারঘাটের ঘাট থেকে আমরা যাব বাঘার একটি পরিবহন ঘাটে। একসময় ওই ঘাটে বড় বড় নৌকা ভিড়ত। তাছাড়া সেখানে পদ্মা বেশ গভীর ও স্বচ্ছ । চাচা বললেন আমাদের যেতে প্রায় তিন ঘণ্টা সময় লেগে যাবে। তবে ফিরতে সময় লাগবে আরও বেশি কারণ তখন আমরা স্রোতের বিপরীতে থাকব । ঠিক বেলা দশটায় আমরা যাত্রা শুরু করলাম ।
ভ্রমণকালীন নদীর দু’ধার:
নৌকায় ওঠার পর থেকেই কাশেম চাচার জীবনের নানা অভিজ্ঞতার কথা শুনছিলাম। তিনি প্রায় ৩০ বছর এ নদীতে নৌকা চালাচ্ছেন। নদীর কত লৌকিক ও অলৌকিক গল্প তিনি আমাদের বললেন । তবে একটি কথা আমার খুব বিশ্বাসযােগ্য মনে হলাে— চারঘাটের কুমিরের কথা। এক সময় নদীর এ অংশে প্রচুর কুমির থাকত। তবে এখন আর নদীতে কোনাে কুমির দেখা যায় না; আমিও কােনাে কুমির দেখিনি। তবে নদীর দু’ধারে দেখা গ্রাম ও প্রকৃতি আমার হৃদয়কে হরণ করেছিল । হাটের দিন থাকায় আমি নদীর ধারের মানুষের ব্যস্ততার অনেক চিত্রই দেখতে পেয়েছিলাম । হাতের ডিজিটাল ক্যামেরাটায় সেসব ছবি যত্ন করে ধরে রেখেছিলাম আমি।
ভ্রমণকালীন নদীর দৃশ্য:
নৌকায় থেকে নদী দেখা এ আমার প্রথম । অষ্টম শ্রেণিতে আমি বুদ্ধদেব বসুর ‘নদীর স্বপ্ন’ কবিতা পড়েছিলাম। সেখানকার ছােকানু ও তার কিশাের ভাইয়ের কথা আমার বার বার মনে পড়ছিল। তারা সারাদিন নদীতে কত দৃশ্য দেখেছিল । আমিও তাদের মতাে নদীতে পালতােলা নৌকার ছুটে চলা প্রত্যক্ষ করলাম মাছ ধরার সময় এখন নয়; তারপরও কত জেলে নদীতে জাল ফেলছে এবং দু’একটা করে মাইও ধরছে । একটা বিয়ের নৌকা দেখতে পেলাম; নবদম্পতি নৌকায় বেশ আনন্দ নিয়ে যাচ্ছিল; তবে সেটি যন্ত্রচালিত নৌকা ছিল । তাছাড়া নদীতে বালুর নৌকাও দেখতে পেলাম। চাচা বললেন ‘ঐ নৌকাগুলাে শুধু বালু তােলার কাজেই ব্যবহার করা হয়।’
নদীতে সূর্যাস্ত:
বাঘার ঘাটে পৌঁছে কাশেম চাচা ও অামরা অনেকক্ষণ বিশ্রাম করলাম । তারপর আবার রওনা হলাম আমরা।
কাশেম চাচা নৌকার পাটাতনের ভেতর থেকে একটি চার্জার লাইট বের করলেন। আমি দেখে হেসে ফেললাম। তিনি বললেন, ‘একসময় সব নৌকায় হারিকেন জ্বলত, কিন্তু এখন আর কেউ হারিকেন ব্যবহার করে না।’ কিছুদূর আসতেই সূর্যাস্ত নেমে এলাে নদীর বুকে। পশ্চিম দিক লাল রঙে সজ্জিত হলাে । পাখিরা ফিরতে থাকল ঘরে।নৌকাগুলােও আস্তে আস্তে পাড়ে ভিড়তে থাকল । কিন্তু বৈদ্যুতিক বাতির কল্যাণে নদীর ধারের ইলেকট্রিক খুঁটিগুলাে জ্বলে উঠল । অন্ধকারের নিস্তব্দতা যেন ভেঙে গেল ওই সময়ে।
নদীতে রাত্রিকালীন সময়:
সূর্যাস্তের পর পূর্ণিমার পূর্ণ চাঁদ আকাশে ভেসে উঠল । নদীর জলে সেই চাদের প্রতিচ্ছায়া পড়ল। আমি আর সােহেল জলে টেউ দিতে থাকলাম আর আকাশের চাদটা যেন তার কিরণ আরও বিচ্ছুরণ করতে লাগল । চারিদিক চাদের আলােয় ভরে গেছে ততক্ষণে। কাশেম চাচাকে একটা গান ধরতে বললাম। প্রথমে তিনি একটু সংকোচ করলেন; তারপর ধীর গলায় ধরলেন ‘সােয়াচান পাখি… আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি।’
ভ্রমণের সমাপ্তি:
আমরা ফিরে এলাম আমাদের যাত্রা শুরুর স্থানে। কিছু খাবার-দাবার বেঁচেছিল। কাশেম চাচার হাতে দিয়ে
বললাম বাড়িতে নিয়ে যেতে। তিনি চলে গেলেন, কিন্তু কিছুতেই আমার মন নদীর পাড় থেকে নড়ছিল না। ডিজিটাল ক্যামেরা থেকে বার বার তােলা ছবিগুলাে দেখছিলাম। আর আমার সামনে জীবন্ত হয়ে উঠছিল মুহূর্তগুলাে । মনটা উদাস হয়ে গেল। আমি আর সােহেল ফিরে এলাম বাড়িতে।
উপসংহার:
আমার সমস্ত জীবনে হয়ত নৌকা ভ্রমণের সেই দিনটির স্মৃতি বা অভিজ্ঞতা অমলিন হয়ে থাকবে | নদীর ধারে আমার জীবনের অনেক সময় কেটেছে। কিন্তু তাতে নদীর প্রতি আমার আকর্ষণ এতটুকুও কমেনি। বরং বার বার আমি নদীর বুকে ফিরে যেতে চেয়েছি । কাশেম চাচার নৌকায় বেড়াতে চেয়েছি বার বার । কিন্তু ওই সুযােগ আমার আর হয়নি। জীবন তার অন্য পাঠ আমাকে দিয়ে পড়িয়েছে। তবে মুছে দিতে পারেনি নৌকা ভ্রমণের সেদিনের সেই অভিজ্ঞতা।