বসন্তের প্রকৃতি রচনা লিখন
‘আহা আজি এ বসন্তে
এত ফুল ফোটে, এত বাঁশি বাজে
এত পাখি গায় আহা আজি এ বসন্তে।’
বাংলার ষড়ঋতু পরিক্রমার শেষ ঋতু বসন্ত। শীতের শুষ্কতা আর জীর্ণতার অন্ধকারকে ঘুচিয়ে নবীন আলাের প্রভাত নিয়ে আসে বসন্ত। প্রকৃতিতে লাগে আনন্দের ছন্দহিন্দোল। বসন্ত চিরযুবা ঋতুরাজ। তাই জীর্ণতা আর জরাকে ঝরিয়ে দিয়ে অফুরান প্রাণচাঞল্য ছড়িয়ে দেয় প্রকৃতির মাঝে। শীতের সন্ন্যাসী বসন্তের সাজে হয় চিরচল। বসন্তের আগমনে চঞ্চল কবি হৃদয় বলে ওঠে –
‘কত অপূর্ব পুরাজি ঋতুরাজ বসন্তে ফুটিয়াছে।
ফাল্গুন-চৈত্র এ দুই মাস জুড়েই বসন্তের ব্যাপ্তিকাল ইংরেজি মাসের হিসাবে ফেব্রুয়ারির মধ্যভাগ থেকে এপ্রিলের মধ্যভাগ পর্যন্ত। ফারুন-চৈত্র নিয়ে বসন্তকাল হলেও মূলত ফাল্গুনেই এর মােহনীয় রূপ দেখা যায়। স্বল্পকালব্যাপী বসন্তের অস্তিত্ব লক্ষ করা গেলেও অনির্বচনীয় সৌন্দর্যের আধার বসন্তের প্রকৃতি। কোকিলের কুহুতানে আর আমের মুকুলের গন্ধে আগমন ঘটে বসন্তের। শীতের রিক্ততার ভারে ন্যুজ প্রকৃতি যেন কবির মতােই বলে ওঠে –
‘হে বসন্ত, হে সুন্দর, ধরণীর ধ্যান-ভরা ধন,
বৎসরের শেষে
শুধু একবার মর্ত্যে মূর্তি ধর ভুবন মােহন
নববর বেশে।
প্রকৃতির এ আকুলতার জন্যেই বসন্ত যেন অপরূপ সাজে সজ্জিত হয়ে প্রকৃতির বুকে আগমনী বাণী শােনায়। বীরের কণ্ঠে বলে ওঠে,
‘দাও খুলে দাও দ্বার, ওই তার বেলা হলাে শেষ।
শীতের হিম-মলিন প্রকৃতিতে বসন্ত সংগীত দেয় প্রাণের স্পর্শ। বসন্ত জরাজীর্ণ পাতার বিদায়গাথা রচনা করে।
প্রাণের জয়তােরণ গড়ে আনন্দের তানে’।
ঋতুচক্রের আবর্তনের চাকায় ভর করে প্রকৃতিকে সার্থকতা দান করতেই রূপময় ফারুনের আবির্ভাব ঘটে। উত্তরের হিমেল হাওয়া বিদায় নেয় দখিনা বাতাসের মৃদু চরণধ্বনি শুনে। অকারণ আন্দোলনে অশােকের বন হয় চল, বন কিশলয় ওঠে নেচে, বনে বনে জাগে পাখিদের গান, নবীন পাতা আর ফুলে প্রকৃতি মেতে ওঠে। দখিনা বাতাসের কৌতুকে পুষ্পগন্ধে প্রকৃতি হয় আকুল। মৃদুমন্দ দখিনা বাতাসের স্পর্শে সে প্রকৃতির মর্মদোলায় দেয় দোল । আর নতুন আলােয় প্রকৃতিকে রাঙিয়ে
দিতে সে বলতে থাকে –
‘খােল রে দুয়ার খােল’।
কবির কণ্ঠেও এ সময় শােনা যায় বসন্তের জয়গান –
‘জাগুক মন, কাঁপুক বন উড়ুক ঝরা পাতা
উঠুক জয়, তােমারি জয়, তােমারি জয়গাথা।
বসন্তের আগমনে প্রকৃতি যেন বর্ণে-গন্ধে-রূপে-রসে আপনার রূপমাধুর্য তুলে ধরে। শীতের জীর্ণতাকে বিদায় করে দিয়ে প্রকৃতিকে অপরূপ ঔজ্জ্বল্য দান করে বসন্ত। নতুন সংগীতে আর নতুন উৎসবে প্রকৃতি হয় আত্মহারা । ক্লান্ত প্রকৃতিতে বসন্ত শােভা যেন নিদ্রাভঙ্গের বাঁশি বাজায় যে পাতা শীতের শুষ্কতায় প্রাণ হারিয়ে পড়ি পড়ি অবস্থা, বসন্তের আগমন তাকে ঝরিয়ে দিয়ে জাগিয়ে দেয় নতুন প্রাণস্পন্দনে। গাছের শাখা-প্রশাখায় নতুন পাতার সম্ভার প্রকৃতিকে যেন সবুজের কারুকার্যে। পরিপূর্ণ করে অশােক, পলাশ, কৃষ্ণচূড়া, শিমুল আর জারুলের গাছে ফুলের সমারােহে আর কোকিলের গানে প্রকৃতি যেন নতুন প্রাণস্পর্শে জেগে ওঠে। বসন্তের রঙের শােভায় নবীন ঐশ্বর্যে প্রকৃতি সেজে ওঠে। সে সৌন্দর্যে জ্যোতির্ময় হয় চারদিক। বসন্ত-প্রকৃতির নান্দনিক ছোঁয়া চোখে জাগায় স্বপ্ন। চিত্ত হয় আনন্দে ভরপুর। রূপবিভাের কবি বলে ওঠেন –
‘বসন্তকাল এসেছে মাের ঘরে –
জানলা দিয়ে চেয়ে আকাশ পানে।
আনন্দ আজ ক্ষণে ক্ষণে জেগে উঠছে প্রাণে।
সীমাহীন ঐশ্বর্যের মােহনীয় রূপে, নিত্যনতুনের লীলা হিতে শােভায় বসন্ত হয়ে ওঠে ঋতুরাজ। কিন্তু বসন্ত প্রকৃতির সে অপরূপ রূপ মাধুর্য খুবই ক্ষণস্থায়ী । ফানুন-চৈত্র মিলে বসন্তের ব্যাপ্তি হলেও চৈত্রের আগমনের সাথে সাথেই প্রকৃতি হয়ে ওঠে উত্তপ্ত। কৃষ্ণচূড়া, শিমুল আর অশােকের লাল রঙে যে প্রকৃতি হয় রক্ত লাল, চৈত্রের তীব্র তাপদাহ সে রঙকে করে মলিন। শােনা যায়। কালবৈশাখির পদধ্বনি। কবির ভাষায় –
“চৈত্রমাসের-হাওয়ায় কাপা দোলনচাপার কুঁড়িখানি
প্রলয়-দাহের রৌদ্রতাপে বৈশাখে আজ ফুটবে জানি।
চৈত্রের আগমন মূলত গ্রীষ্মের আগমনী বার্তা আর বসন্তের মােহমুগ্ধ রূপের বিদায়ী সংগীত। চৈত্র বনে বনে, গাছের শাখায় শাখায়, ফসলের খেতে বেলাশেষের সংগীত বাজায়। আলাের সােনার কাঠিতে বসুন্ধরার বুকে নবজীবনের মায়া জাগায় ফাগুন আর চৈত্র বিপুল ব্যথায় তাকে বিদায় জানায়। বসন্তের এ ক্ষণস্থায়ী রূপ দেখে কবি তাই বলেন –
“হে বসন্ত, হে সুন্দর, হায় হায়, তােমার করুণা
ক্ষণকাল, তরে।
মিলাইবে এ উত্সব, এ হাসি, এ দেখাশুনা
শূন্য নীলাম্বরে।
এভাবে বসন্তের ছোঁয়ায় অস্থির পুস্পশাখা হয় ফুলে ফুলে রঙিন, অশান্ত ফুল পেতে চায় ফল। স্তন্ধ নীরবতা হতে চায় চল । বসন্তে উন্মাদ সংগীতের উদ্দাম আবেগে প্রকৃতি বিস্ময়াভিভূত করে সবাইকে। আর চৈতালি ঝড় উড়িয়ে নেয় পাতা-ফুল সব। ক্রমেই বর্ষা পরিক্রমায় ফিরে আসে গ্রীষ্ম পরিবেশ বর্ণনা।