Table of Contents
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও অর্থনৈতিক মুক্তি রচনার সংকেত
- ভূমিকা
- স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্বে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা
- স্বাধীনতা পরবর্তী অর্থনৈতিক অবস্থা
- বর্তমান প্রেক্ষাপট
- উপসংহার
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও অর্থনৈতিক মুক্তি রচনা
ভূমিকা:
বাঙালি জাতির সর্বাপেক্ষা গৌরবের ইতিহাস তার স্বাধীনতার ইতিহাস । ভৌগােলিক অবস্থান ও প্রাকৃতিক পরিবেশের কারণে শান্তিপ্রিয় হলেও কারাের অধীনতা বাঙালি জাতি কোনােদিন মেনে নেয়নি। অন্যায় ও শােষণের বিরুদ্ধে বাঙালিরঅবস্থান চিরকালই ছিল প্রতিবাদী। তাই এখানে বার বার বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠেছে। সে আগুনে বার বার প্রকম্পিতহয়েছে পরাশক্তির ভিত ও শােষণের ভিত্তিভূমি। স্বাধীনতাপ্রিয় বাঙালির আজন্ম স্বপ্ন ও সাধনা ছিল পরাধীনতার নাগপাশ থেকেমুক্তি লাভ করা। আর এ বােধ থেকেই পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর হাত থেকে মুক্তির জন্য ১৯৭১ সালে সর্বস্তরের বাঙালিজীবন বাজি রেখে ঝাপিয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে । দীর্ঘ নয় মাসের রক্ষক্ষয়ী সংগ্রামের ভেতর দিয়ে বাঙালি অর্জন করে প্রাণপ্রিয়স্বাধীনতা । এ স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে একদিকে যেমন সার্বভৌমত্ব রক্ষার দাবি সক্রিয় ছিল তেমনি অর্থনৈতিক স্বাধীনতাসহসার্বিক মুক্তি অর্জন ছিল এর অন্যতম লক্ষ্য।
স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্বে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা:
১৯৪৭ সালে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান নামে দুটি প্রদেশ নিয়েপাকিস্তান স্বাধীনতা অর্জন করে। পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার ফলে এদেশের মানুষের প্রত্যাশা ছিল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকমুক্তির সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক মুক্তি আসবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠীর বৈষম্যমূলক নীতিরফলে পাকিস্তানের সমগ্র অর্থনীতি পশ্চিম পাকিস্তানকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হচ্ছে। কলকারখানা, শিল্পপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরুকরে অফিস আদালত সবই পশ্চিম পাকিস্তানকেন্দ্রিক পরিচালিত হতে থাকে । পূর্ব পাকিস্তানের সর্বস্তরের জনতা এ অর্থনৈতিকবৈষম্য মেনে নিতে পারেনি বলে স্বাধিকার ও আন্দোলনের প্রয়ােজনীয়তা দেখা দেয়। পূর্ব পাকিস্তানের সমাজকাঠামাে ছিল মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণিভিত্তিক, অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের সমাজকাঠামাে ছিলভূস্বামী, পুঁজিপতি ও মধ্যবিত্ত শ্রেণিভিত্তিক। সমাজকাঠামাের এ বৈপরীত্যের কারণে পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব পাকিস্তানেরওপর শােষণের নীতি গ্রহণ করে। কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থায় পূর্ব পাকিস্তানিদের যােগ্য প্রতিনিধি না থাকায় পূর্ব পাকিস্তানবাসীরাশােষণ ও বঞ্চনার শিকার হয় বেশি। ১৯৪৭-৭০ সাল পর্যন্ত দুই পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা পর্যালােচনা করলে দেখা| যায় আমদানি খাতে পূর্ব পাকিস্তানে ব্যয় হতাে ৬৩০ কোটি টাকা আর পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় হতে ৩৭৯৯ কোটি টাকা।শাসনখাতে পূর্ব পাকিস্তানে ব্যয় ২৬৯ কোটি টাকা আর পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যয় ছিল ১৯৪৭ কোটি টাকা। উন্নয়নমূলক খাতেপূর্ব পাকিস্তানের ব্যয় ছিল মাত্র ২১১৪ কোটি টাকা আর পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যয় ছিল ৫৩৯৫ কোটি টাকা। পূর্ব পাকিস্তানেরমাথাপিছু গড় আয় ছিল ৩৩১ টাকা আর পশ্চিম পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় ৫৩৩ টাকা। এ ছাড়াও শিল্পকারখানার প্রায় সবইপ্রতিষ্ঠিত হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। পূর্ব পাকিস্তানে একমাত্র আদমজি জুটমিল ব্যতীত উল্লেখ করার মতাে তেমন কোনােশিল্পপ্রতিষ্ঠান ছিল না বললেই চলে। এ অর্থনৈতিক বৈষম্যের ফলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ স্বাধীনতার জন্যে মরিয়া হয়ে ওঠেএবং দীর্ঘ নয় মাসব্যাপী এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জন করে স্বাধীনতা।
স্বাধীনতা পরবর্তী অর্থনৈতিক অবস্থা:
যুদ্ধের ভয়াবহতা কাটিয়ে উঠতে বাংলাদেশের প্রায় এক দশক সময় লেগে যায়। ধীরে ধীরেএদেশের কৃষি ও বাণিজ্যিক অর্থনীতির ধারা উন্নতির দিকে এগিয়ে যায়। সরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে ছােট বড়শিল্পকারখানা। বাংলার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক, সরকারি, আধাসরকারি ও প্রাইভেট মিলে প্রায়ডজনখানেক বাণিজ্যিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে মুক্তবাজার অর্থনীতির ফলে এদেশের চা, বস্ত্রশিল্প, পাটজাত সামগ্রী প্রভৃতিবিদেশে রপ্তানির মধ্য দিয়ে অর্জিত হচ্ছে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। জনশক্তি রপ্তানির মাধ্যমেও প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে।রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় খাত হচ্ছে তৈরি পােশাকশিল্প স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশেরঅর্থনীতি অনেক এগিয়েছে। তবে কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন আজও সম্ভব হয়নি দুর্নীতি ও অরাজকতার কারণে।
বর্তমান প্রেক্ষাপট:
যে স্বপ্ন বা আকাঙ্ক্ষাকে সামনে রেখে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল সেই স্বপ্ন নানা কারণেই গত ৪৫ বছরেওসাফল্যের লক্ষ্যমাত্রা স্পর্শ করতে পারেনি। স্বাধীনতার পর বার বার সামরিক অভ্যুত্থান, হত্যা আর রক্তপাতের মধ্য দিয়ে।ক্ষমতা দখল, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরােধী দেশি ও বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের অপতৎপরতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, যুবসমাজের মধ্যেসৃষ্ট হতাশা, বেকারত্ব, জনস্ফীতি, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, ঘুষ-দুর্নীতি ইত্যাদির ক্রমবৃদ্ধির কারণে ব্যাহত হচ্ছে আমাদের।কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক উন্নয়ন। ফলে সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জনের মূল পরিকল্পনাই ভেস্তে যাচ্ছে। এ অবস্থাথেকে উত্তরণের জন্য পরিকল্পিত বাজেট প্রণয়ন, কলকারখানা, শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তােলা, বিজ্ঞানসম্মত কৃষিব্যবস্থা সূচনারমাধ্যমে এগিয়ে নিতে হবে আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে।
উপসংহার:
সামগ্রিক আলােচনা থেকে আমরা এ সত্যে উপনীত হতে পারি যে, অর্থনৈতিক মুক্তি ও সাম্য প্রতিষ্ঠার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৯৭১ সালে আমরা যে কঠিন আত্মত্যাগের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছি তা হচ্ছে রাজনৈতিক স্বাধীনতা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাতখনই সাফল্যে উদ্ভাসিত হবে যখন রাজনৈতিক স্বাধীনতা আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক স্বাধীনতায় রূপান্তরিত হবে। সেই লক্ষ্যে আজসমাজের সর্বস্তরে মুক্তিযুদ্ধের মহান চেতনাকে ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়ােজন। দেশের প্রতিটি মানুষের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের মহৎ লক্ষ্যসমূহসঞ্চারিত করা গেলে তবেই আমাদের স্বাধীনতা সত্যিকার অর্থে এক গৌরবময় স্তরে উত্তীর্ণ হবে।