Table of Contents
বাংলাদেশের মৎস্যসম্পদ রচনার সংকেত
- ভূমিকা
- বাংলাদেশে মাছের আবাসস্থল
- মৎস্য সম্পদের অর্থনৈতিক গুরুত্ব
- বাংলাদেশে মৎস্য খাতে বিরাজমান সমস্যা
- মৎস্যসম্পদের সমস্যা সমাধানের উপায়
- উপসংহার
বাংলাদেশের মৎস্যসম্পদ রচনা
ভূমিকা:
মাছে-ভাতে বাঙালি’– এ প্রবাদটি আবহমান কাল ধরে বাঙালির রুচি ও রসনার পরিচয়বাহী। সুপ্রাচীনকাল থেকেই মানুষ খাদ্যের জন্য প্রকৃতির দান গ্রহণ করে আসছে। আর নদীমাতৃক বাংলাদেশে আমাদের খাদ্য তালিকায় প্রাণিজ আমিষের প্রধান উৎসই হলাে মাছ। দেশের মানুষের পুষ্টিচাহিদা পূরণ, মাছ রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, দেশে কর্মসংস্থান- সব মিলিয়ে মৎস্যসম্পদ দেশের অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাত।
বাংলাদেশে মাছের আবাসস্থল:
বাস্তুসংস্থানিক দিক থেকে বাংলাদেশের মৎস্যসম্পদকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। এগুলাে হলাে: ক, স্বাদু বা মিঠাপানির মাছ, খ. লােনাপানির মাছ এবং গ. মৃদু লােনাপানির মাছ।
১. স্বাদু বা মিঠাপানির মাছ: নদীমাতৃক বাংলাদেশে রয়েছে অসংখ্য নদনদী, ঝিল, খালবিল, হাওর-বাঁওড়, পুকুর, দিচ্ছি ইত্যাদি বিচিত্র জলাশয়। এর সবই স্বাদুপানির মাছের আধার। দেশে ধৃত মাছের শতকরা ষাট ভাগ আসে নদী থেকে। প্রায় সব নদীর গতিপথেই রয়েছে বিস্তৃত প্লাবনভূমি। এসব প্লাবনভূমিতেও প্রচুর মাছ উৎপাদন হয়ে থাকে
২.লােনাপানির মাছ: বাংলাদেশের দক্ষিণ সীমানাজুড়ে রয়েছে বঙ্গোপসাগরের চারশ আশি কিলােমিটার দীর্ঘ উপকূল। গভীর সমুদ্র উপকূল ও মােহনা লােনাপানির মাছের বিশাল বিচরণক্ষেত্র । সমুদ্রের লােনাপানিতে সারা বছরজুড়ে বিভিন্ন
ধরনের মাছ পাওয়া যায়।
৩. মৃদু লােনাপানির মাছ: বাংলাদেশের খুলনা, সাতক্ষীরা, চকোরিয়া ও কক্সবাজারের উপকূল সংলগ্ন এলাকা মৃদু লােনা পানির মাছের উৎস। মিঠাপানির মাছের মধ্যে রয়েছে পুঁটি, বাটা, বাইম, ভেদা, বাপা, বাঁশপাতা, বেলে, চাপিলা, চিতল, পােয়া, মলা, টেংরাসহ আরও অনেক মাছ। লােনাপানির মাছের মধ্যে প্রধান ইলিশ ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ। এছাড়াও রূপচাদা, ছুরি, লাক্ষা, লটিয়া প্রভৃতি লােনাপানির মাছ। আর মৃদু লােনার মাছের মধ্যে প্রধান গলদা চিংড়ি ও ভেটকি
মৎস্য সম্পদের অর্থনৈতিক গুরুত্ব:
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মৎস্যসম্পদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মাছ ধরার কাজ কৃষিকাজের চেয়েও পুরােনাে। এটি খাদ্যপুষ্টি, কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান খাত। বিদেশে মাছ রপ্তানি করে বাংলাদেশ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। জাতীয় আয়ের তিন থেকে পাঁচ শতাংশ এবং রপ্তানি আয়ের দশ শতাংশ আসে মৎস্য খাত থেকে। দেশের প্রায় বিশ লক্ষ মানুষ মৎস্য উৎপাদন ও বিপণনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। আর পরােক্ষভাবে মৎস্য খাতের সাথে জীবিকার সম্পৃক্ততা রয়েছে প্রায় এক কোটি দশ লক্ষ মানুষের। বাংলাদেশের মানুষ মােট প্রাণিজ আমিষের ষাট শতাংশ পেয়ে থাকে মাছ থেকে। কেবল খাদ্য হিসেবে নয়, মৎস্যজাত বিভিন্ন পণ্যের অর্থনৈতিক গুরুত্বও কোনাে অংশে কম নয়। সাবান, মােম ও গ্লিসারিন শিল্পের কাঁচামাল আসে মৎস্যসম্পদের উপজাত থেকে। হাঙর ও মর্ডিন মাছের তেল রং তৈরি এবং ইস্পাত ও পাট উৎপাদন প্রক্রিয়ায় কাজে লাগে। চামড়া শিল্পে চামড়া মােলায়েম করার কাজেও এ তেল ব্যবহৃত হয়। বিভিন্ন মাছের তেল থেকে পাওয়া যায় ভিটামিন ‘এ’ ও ‘বি’ । মাছের পেশীকলায় বা আমিষে ষাট থেকে আশি শতাংশ পানি, তেরাে থেকে বিশ শতাংশ প্রােটিন এবং চর্বি থাকে। এসব উপাদান শরীরে পুষ্টিসাধন ও রােগ নিরাময়ে সহায়তা করে।
বাংলাদেশে মৎস্য খাতে বিরাজমান সমস্যা:
জনসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি মৎস্য উৎপাদন খাতে বিরাজমান নানা সমস্যার কারণে মাথাপিছু মাছ গ্রহণের পরিমাণ অনেক কমে গেছে। বাংলাদেশে দৈনিক মাথাপিছু মাছের প্রয়ােজন কমপক্ষে ৩৮ গ্রাম। কিন্তু সে অনুযায়ী মাছ উৎপাদন হচ্ছে না। মাছের এ অভাবের কারণগুলাে হলাে—
১. বন্যা নিয়ন্ত্রণ, খাল খনন ও জলসেচের জন্য ব্যাপকভাবে পানি ও ভূমি সংস্কারের উদ্যোগ নেয়ায় জলজ আবাসস্থল। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে মাছের বিচরণক্ষেত্র ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে।
২. ফসলের মাঠে কীটনাশক ব্যবহারের ফলে বৃষ্টিবিধৌত পানি জলাশয়ে মিশে মাছের ক্ষতি হচ্ছে।
৩.গভীর নলকূপ খনন, শুকনাে মৌসুমে জলাশয়ের পানি কমে যাওয়া ইত্যাদি কারণেও মাছের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
৪. পােনা মাছ ও ডিমওয়ালা মাছ শিকারের ফলেও মাছের উৎপাদন ব্যাহত হয়। ব্যাপকহারে জাটকা নিধন ইলিশ উৎপাদনে বিরাট বাধা।
৫. জলাশয়গুলােতে রাসায়নিক ও শিল্প বর্জ্য, বিষাক্ত আবর্জনা, পলিথিন ইত্যাদি মিশে যাওয়ায় মাছের স্বাভাবিক উৎপাদনে
বিঘ্ন ঘটছে।
৬.প্রতিবেশী দেশগুলাে বিশেষ করে মায়ানমার ও থাইল্যান্ডের জলদস্যুরা উপকূলবর্তী সমুদে অবৈধভাবে মাছ শিকার করায়
মাছের ঘাটতি দেখা দিচ্ছে।
মৎস্যসম্পদের সমস্যা সমাধানের উপায়:
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ হওয়ায় মৎস্যসম্পদের উন্নয়নের সম্ভাবনাও যথেষ্ট। এ লক্ষ্যে
১. পােনা মাছ ও ডিমওয়ালা মাছ শিকার সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করার জন্য প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে ।
২. জলাশয়গুলাের সংস্কার করতে হবে; কৃত্রিম ও বিষাক্ত বর্জ্য যাতে জলাশয়ের ক্ষতি করতে না পারে সে ব্যাপারে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
৩, আধুনিক পন্থায় মাছচাষের প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ব্যাপারে মাছচাষে সম্পৃক্তদের প্রয়ােজনীয় প্রশিক্ষণ দিতে
৪. মাছ সংরক্ষণ পরিবহণ ও বিপণনের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে।
৫. জলদস্যুতা বন্ধ করতে হবে ।
ইতােমধ্যে দেশের সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক খাত হিসেবে মাহচাষের উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকারিভাবে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ফলে সামগ্রিকভাবে মাছের
উৎপাদন তুলনামূলকভাবে বেড়েছে
উপসংহার:
মাছ আমাদের দেশের রুপালি সম্পদ। এ সম্পদ রক্ষা ও সমপ্রসারণে সচেতন হলে দেশের মানুষের পুষ্টি চাহিদা মিটবে। সেই সাথে বিদেশে মাছ রপ্তানির মাধ্যমে অর্জিত হবে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা । এভাবে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সম্ভব। সেই সাথে প্রচুর লােক আত্মকর্মসংস্থানের সুযােগ পাবে। তাই সরকারের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সকলকে সচেতন হয়ে মৎস্যসম্পদ উৎপাদন ও রক্ষণাবেক্ষণে সচেষ্ট হতে হবে। তবেই দেশের রুপালি সম্পদের ভবিষ্যৎ হবে উজ্জ্বল।