যখন সন্ধ্যা নামে রচনা লিখন
সন্ধ্যা প্রকৃতির এক মায়াবী ক্ষণ। আলােকোজ্জ্বল কর্মমুখর দিন আর দীর্ঘ অবসন্ন রাত্রির মাঝামাঝি সময়ে সে আসে ক্ষণিকের অতিথির মতাে। এসে আবার মিলিয়ে যায়। নিয়ে আসে দিন শেষের বারতা, করে রাত্রির আবাহন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়,
‘দিনের ভাটার শেষে রাত্রির জোয়ার’।
সন্ধ্যার প্রকৃতিতে সূর্য থাকে ক্লান্ত, অবসন্ন। সারাদিনের তেজোদীপ্ত গৌরব সে হারাতে বসে। দীর্ঘ পথপরিক্রমা শেষে সে যেন একটু বিশ্রাম খোজে। বিদায়ী সূর্যের আলােটুকুও কেমন অচেনা লাগে— খানিকটা রক্তিম, খানিকটা লাজনম্র আর এ রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়ে দিগন্ত থেকে দিগন্তে, প্রকৃতির পরতে পরতে। সন্ধ্যা স্বভাবে কোমল, শান্ত। সে আসে ধীর পায়ে। নীরবতাই তার ভাষা। কিন্তু সে নীরব ভাষা আবেগে পরিপূর্ণ। আর এ আবেগ ছড়িয়ে পড়ে মানব হৃদয়ে। জীবন আর প্রকৃতি যেন ভাবে বিলীন হয়ে যায় সান্ধ্য মায়ার আবেশে । পলায়নপর আলাে আর আঁধারের সমাপনী খেলায় প্রকৃতিকে মনে হয় মায়াপুরী, ছায়াপুরী । সন্ধ্যা শান্তিময়ী, নীরব, গম্ভীর। নিঃশব্দে সে ধরার আঁচল ভরিয়ে দেয় পরম মমতায় । কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন-
‘দিনের ক্লান্তির শেষে শিশিরের শব্দের মতাে সন্ধ্যা নামে ‘ তাই সন্ধ্যাকে মনে হয় খানিকটা বিষন্ন । এ বিষণ্ণতার গভীরে মানবমনও যেন বিষন্ন হয়ে পড়ে।
মানুষের সারাদিন কাটে কোলাহলমুখর কর্মব্যস্ততায় । সন্ধ্যায় এর অবসান হয়, মানুষ ঘরে ফেরে । ঘরে ফেরে পাখিরাও। অস্তায়মান সূর্যের সােনালি কোমল আভা ছড়িয়ে থাকে পাহাড় চূড়ায়, গাছের উঁচু ডালে, আর পাখির ডানায় । সন্ধ্যার সাথে যেন পাখিদের নিবিড় সখ্য। সন্ধ্যারাত্রি পাখিদের কানে কানে বলে দেয়, নীড়ে ফেরার সময় হলাে। বিদায়ী সূর্যের স্বর্ণরেখার পরশ ডানায় মেখে পাখিরা ফিরে চলে নীড়ে। পাহাড়গুলােকে মনে হয় যেন সােনার মুকুট পরেছে । দ্রুতই সে রং আবার হারিয়ে যায়। সূর্য তখন আরও ম্লান, অপম্রিয়মাণ। প্রকৃতিতে নেমে আসে ছায়া সুনিবিড় প্রশান্তি। ধরণীকে এক অপূর্ব, অস্পষ্ট মায়ায় আচ্ছন্ন করে সন্ধ্যা নেমে আসে আকাশ-বাতাসজুড়ে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ঘরের খেয়া’ কবিতায় সন্ধ্যার রূপ দিয়েছেন
‘সন্ধ্যা হয়ে আসে,
সােনা মিশেল ধূসর আলাে ঘিরল চারি পাশে।
নৌকাখানা বাঁধা আমার মধ্যিখানের গাঙে;
অস্তরবির কাছে নয়ন কী যেন ধন মাঙে
আপন গায়ে কুটির আমার দূরের পটে লেখা,
ঝাপসা আভায় যাচ্ছে দেখা বেগুনি রঙের রেখা।’
সন্ধ্যার রং বিচিত্র । কিন্তু এ বিচিত্র রপে নেই চোখ ধাঁধানাে উজ্জ্বলতা, মায়াময় স্নিগ্ধতাই সন্ধ্যার প্রকৃত রূপ। ধরণীতে প্রতিদিন আপন নিয়মে সন্ধ্যা আসে। তবে শহর আর গ্রামের পরিবেশে কিছুটা ভিন্নভাবে সে ধরা দেয়। শহরের সন্ধ্যার নির্জন রূপ কোলাহল মুখরতায় বিলীন হয়ে যায় । ঘরে ঘরে আর ব্যস্ত সড়কগুলােতে জ্বলে ওঠে সড়ক বাতি। দোকানপাট আলােয় ঝলমল করে। এর উজ্জ্বলতার কাছে লাজনম্র সন্ধ্যার রং কোথায় যেন হারিয়ে যায়। যানবাহনের অবিরাম চেঁচামেচি, অফিস ফেরতাদের বাড়ি ফেরার ব্যস্ততা, শহরে পাখিদের নীড়ে ফেরা – সবই যেন চুপটি করে চেয়ে দেখে মৌন সন্ধ্যা। কেবল যান্ত্রিক সভ্যতায় হারিয়ে যাওয়া মানুষের সন্ধ্যার রূপমুগ্ধতা দেখবার অবকাশ থাকে না। তাই বলে সন্ধ্যা অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নেয় না। সুউচ্চ দালানে, পাখির ডানায়, গাছের পাতায় পাতায় গােধূলি বেলার আভা ছড়িয়ে দেয়। মৃদুমন্দ বাতাস বয় । সূর্য ডুবে যাবার পরও লালচে আভা ছড়িয়ে থাকে চারপাশে। হৃদয়ের গভীর উপলব্ধি দিয়েই কেবল শহুরে সন্ধ্যার রূপ চেনা যায় ।
গাঁয়ের শান্ত-শ্যামল রূপের সাথে সন্ধ্যার স্নিগ্ধ কোমল রূপের যেন পরম মিতালি। দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ, ফসলের খেত আর নদীর শান্ত জলে নামে সান্ধ্য ছায়া। ক্লান্ত রাখাল গরুর পাল নিয়ে বাড়ির পানে যায়, হাট থেকে ফেরে হাটুরে। মাঝি দাঁড় বায়। তার কণ্ঠে কোমল বিষাদের গান । সে গানের সুর ভেসে বেড়ায় মৃদুমন্দ বাতাসে । হারিয়ে যায় দূর থেকে দূরে। মাথায় ফসলের বােঝা নিয়ে বাড়ি ফেরে কৃষক। পাখিরাও ঘরে ফেরে। মাঝে মাঝে কোনাে ঝােপালাে গাছে অনেক পাখির কলকাকলি শােনা যায় । চকিতে চমক ভাঙে পথিকের। গাঁয়ের ছায়া-সুনিবিড় বাড়িগুলােও শান্ত, চুপচাপ। নিকোনাে উঠোনে গাছের ছায়ায় গাঢ় অন্ধকার নেমে আসে। দূর থেকে ভেসে আসে আজানের ধ্বনি, মন্দিরে বাজে কাসর ঘণ্টা। জোনাকিরা চল হয়। এবার তাদের দল বেঁধে বেরিয়ে পড়ার পালা । সন্ধ্যাতারাও প্রস্তুতি নেয়, গােধূলির আলাে মিলিয়ে যেতে না। যেতেই আকাশে মিটমিট করে জ্বলে । গ্রামে সন্ধ্যার নিবিড় কোমল রূপ ফুটে উঠেছে রবীন্দ্রনাথের ‘সন্ধ্যা’ কবিতায়-
‘হেরাে ক্ষুদ্র নদীতীরে
সুপ্তপ্রায় গ্রাম। পক্ষীরা গিয়েছে নীড়ে,
শিশুরা খেলে না, শূন্য মাঠ জনহীন;
ঘরে ফেরা শ্রান্ত গাভী গুটি দুই-তিন
কুটির অঙ্গনে বাঁধা, ছবির মতােন
স্তন্ধ প্রায়। গৃহকার্য হলাে সমাপন
কে ওই গ্রামের বধূ ধরি বেড়াখানি
সম্মুখে দেখিছে চাহি, ভাবিছে কী জানি
ধূসর সন্ধ্যায়।’
প্রকৃতিতে সন্ধ্যার স্থায়িত্ব ক্ষণিকের। এসেই যেন সে যাবার প্রস্তুতি নেয়। কেননা সে না গেলে যে রাত্রির আবাহন থেমে যাবে। দিনের শেষে পরম স্নেহ আর মমতায় প্রকৃতিকে আগলে রাখে কিছুক্ষণ । তারপর শান্ত, ধীর, অচল পায়ে মিলিয়ে যায় । আসে রাত্রি ।