Table of Contents
পণপ্রথা » যৌতুক প্রথা একটি জাতীয় সমস্যা » নারী স্বাধীনতা ও পণপ্রথা » পণপ্রথার অভিশাপ
যৌতুক প্রথা রচনার সংকেত
- ভূমিকা
- যৌতুক কী
- যৌতুক প্রথার উৎপত্তি
- যৌতুক প্রথার নিগড়ে নারীসমাজ
- যৌতুক প্রথা নিরসনের উপায়
- উপসংহার
যৌতুক প্রথা রচনা
ভূমিকা:
যৌতুক প্রথা এক নির্লজ্জ মানসিকতার অপর নাম। এ প্রথার জটিল আবর্তে জড়িয়ে রয়েছে নারীসমাজ। সুপ্রাচীনকাল থেকেই সমাজে যৌতুক প্রথা চলে আসছে। আধুনিক সভ্যতার বুকেও যা বিরাজ করছে ক্ষতচিহ্নের মতাে।
যৌতুক কী:
আভিধানিক অর্থে বিয়ের সময় বরকনেকে প্রদত্ত ধনকে বলা হয় যৌতুক। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে, বিয়ের সময় বরপক্ষের চাহিদা বা দাবি অনুযায়ী কনেপক্ষ বরপক্ষকে যে অর্থ, ধনসম্পদ, আসবাবপত্র, অলংকার, জমিজমা প্রভৃতি প্রদানের অঙ্গীকার করে তাকেই যৌতুক হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। সেই সাথে কনেপক্ষের নিজেদের আগ্রহে যেসব অর্থসম্পদ বরকনেকে দেওয়া হয় তাও যৌতুকের পর্যায়ে পড়ে। তবে মুসলমান সমাজে ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী বর বিয়ের সময় কনেকে যে দেনমােহর দেয় তা যৌতুকের পর্যায়ে পড়ে না।
যৌতুক প্রথার উৎপত্তি:
হিন্দু ধর্ম মতে, পরিবারের মেয়েদের পৈতৃক সম্পত্তিতে কোনাে অধিকার থাকে না। তাই হিন্দুসমাজে বাবা-মা মেয়ের বিয়েতে সাধ্যমতাে উপঢৌকন দেয়। এটিই যৌতুক প্রথার অন্যতম উৎস। এছাড়া বাংলায় মধ্যযুগে রাজা বল্লাল সেন কৌলীন্য প্রথা প্রবর্তন করেন। কৌলীন্য প্রথা অনুযায়ী, সমাজে সম্রান্ত ও উচ্চ বংশীয়রা বিশেষ সম্মান ও মর্যাদা ভােগ করত। সে যুগে তারা কুলীন বংশীয় হিসেবে পরিচিত ছিল। এ কুলীন বংশীয় পাত্রের সাথে মেয়ের বিয়ে দিতে নানা উপঢৌকন দিয়ে বরকে প্রলুব্ধ করতে চাইতেন বাবা-মা। এ কৌলীন্য প্রথাও যৌতুক প্রথার প্রসার ঘটিয়েছে। পরবর্তীকালে মুসলমান সমাজেও বিস্তার ঘটেছে যৌতুক প্রথার। এ কুপ্রথার সাথে যেহেতু অর্থসম্পদ প্রাপ্তির বিষয়টি জড়িত তাই ধীরে ধীরে যৌতুক নিয়ে শুরু হয়েছে পক্ষের দর কষাকষি এবং স্ত্রীকে নির্যাতনের মাধ্যমে যৌতুক আদায়ের প্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলেছে
যৌতুক প্রথার নিগড়ে নারীসমাজ:
আধুনিক যুগে বাংলাদেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর অধিকার স্বীকৃতি পেয়েছে। শিক্ষাদীক্ষায় ও কর্মক্ষেত্রে নারীরা পুরুষের সাথে সমানতালে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু যৌতুক প্রথার নিষ্ঠুর নাগপাশ থেকে নারীসমাজ মুক্তি পায়নি। জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি মানব উন্নয়নের প্রতিবেদনে প্রকাশ, যৌতুকের কারণে সমাজে অহরহ নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে এবং এর নানামুখী নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সমাজে। বর্তমানে যৌতুক কেবল বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। বিয়ের পরবর্তী সময়ে স্ত্রীকে চাপ দিয়ে নির্যাতন করে স্ত্রীর অভিভাবকের কাছ থেকে যৌতুক আদায়ের ঘটনাও ঘটছে। নারীরা শারীরিক, মানসিক ও অপ্রীতিকর নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। নারীরা যে কেবল স্বামীর দ্বারাই নির্যাতিত হচ্ছে তা নয়, শ্বশুর-শাশুড়ি, ননদ-দেবর মােটকথা শ্বশুরপক্ষের নির্যাতনে- অপমানে-অবহেলায় শ্বশুরবাড়িতে বধূর জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। ক্ষোভে-অপমানে অনেক নারী আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। অনেক নারীকে হত্যা করে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিচ্ছে শ্বশুরপক্ষ। যৌতুকের কারণে স্বামী-স্ত্রীকে তালাক দিচ্ছে, স্বামী একাধিক বিয়ে করছে, পরিবার ভেঙে যাচ্ছে, ভাঙা পরিবারের সন্তানরা বিপথগামী হচ্ছে, নিম্নবিত্তদের অনেক শিশু বাধ্য হয়ে শিশু শ্রমিকে পরিণত হচ্ছে। যৌতুকের কারণে নারীর দুঃখ-লাঞ্ছনা আর অপমানের চিত্র ফুটে উঠেছে রবীন্দ্রনাথের ‘হৈমন্তী’ গল্পের হৈমন্তী আর ‘দেনা-পাওনা’ গল্পের নিরুপমার চরিত্রে
যৌতুক প্রথা নিরসনের উপায়:
যৌতুক প্রথা নিরসনের লক্ষ্যে বাংলাদেশে ১৯৮০ সালে যৌতুক নিরােধ আইন প্রণীত হয়। এ আইন অনুযায়ী যৌতুক নেয়া এবং দেয়া দুটোই শাস্তিযােগ্য অপরাধ। ২০০০ সালে প্রণীত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের একটি ধারায় বলা হয়েছে, যৌতুকের কারণে হত্যা করলে অথবা আত্মহত্যায় প্ররােচিত করলে অভিযুক্ত ব্যক্তির প্রথমটির জন্য মৃত্যুদণ্ড এবং দ্বিতীয়টির জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং উভয়ক্ষেত্রে উক্ত দণ্ডের অতিরিক্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। এত শাস্তির বিধান থাকা সত্ত্বেও যৌতুক প্রথার অবসান ঘটেনি। তাই দেখা যাচ্ছে, কেবল আইন করে যৌতুক বন্ধ করা। সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়ােজন-
১.আইনের ফাঁক গলে যাতে যৌতুক দেয়া-নেয়া না চলে সে ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া;
২. যৌতুকবিরােধী মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার;
৩. নারী অধিকার রক্ষায় যৌতুক বন্ধে তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করা। পশ্চাৎপদ নারীদের পুরুষনির্ভর মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে দেশের নারী সংগঠনগুলাে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
৪.আইনের সার্থক ও যথাযথ প্রয়ােগ।
উপসংহার:
সর্বংসহা ধরিত্রীর মতােই আমাদের দেশের নারীরা মুখ বুজে সকল অন্যায়-অত্যাচার সহ্য করে যায়। লােকলজ্জার ভয়ে, অর্থের অভাবে কিংবা ন্যায়বিচার পাবার অনিশ্চয়তায় আইনের সাহায্য নিতে চায় না। অথচ নারী আজ আর চার দেয়ালের ঘেরাটোপে বন্দি নেই, সমাজ-সভ্যতা নির্মাণের নানা পর্যায়ে নারীর মেধাবী অবদানে এগিয়ে চলেছে সমাজ পরিস্থিতিতে যৌতুকের মতাে ঘৃণ্যব্যবস্থা কেবল নারীর জন্যই অপমান আর লজ্জা নয়, সমাজেরই কলঙ্ক। তাই কেবল কঠোর আইন করে নয়, যৌতুক বন্ধের জন্য প্রয়ােজন মনের উদারতা, দৃষ্টিভঙ্গির প্রসারতা, সর্বোপরি নারীকে মানুষ হিসেবে মর্যাদা দেবার বিবেক।