Table of Contents
শরীরচর্চা রচনার সংকেত (Hints)
- ভূমিকা
- শরীরচর্চা কী
- শরীরচর্চার প্রয়ােজনীয়তা
- শরীরচর্চার উপায়
- শরীরচর্চা ও শারীরিক শিক্ষা
- শরীরচর্চা ও জাতীয় স্বার্থরক্ষা
- উপসংহার
শরীরচর্চা রচনা
ভূমিকা:
সুস্থ দেহেই সুস্থ মনের বাস। আর সুস্থ-সুন্দর মনই পারে একটা উন্নত জাতির জন্ম দিতে। দেহ-মনে সুস্থ ও
উন্নত জাতিই পারে দেশকে উন্নতি ও সমৃদ্ধির স্বর্ণশিখরে আরােহণ করাতে। দেশকে সমৃদ্ধিশালী করার এ ধারাবাহিকতাকে ক্রমানুসারে সাজালে আমার পাই— সুস্থ দেহ → সুস্থ মন → উন্নত জাতি → উন্নত দেশ। অর্থাৎ গােড়ার কথা হলাে শারীরিক সুস্থতা। এর জন্যে চাই নিয়মিত শরীরচর্চা। কেননা শরীরচর্চাই দৈহিক শক্তি লাভের তথা সবল স্বাস্থ্য লাভের পথ উন্মুক্ত করে দেয়।
শরীরচর্চা কী:
যেকোনাে শারীরিক সক্রিয়তা যা শরীরের প্রত্যেকটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গের তথা সার্বিক স্বাস্থ্যের উপযুক্ততা বাড়িয়ে
তােলে তাকেই শরীরচর্চা বলে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর কার্যকর অবদান রয়েছে। যেমন- পেশির শক্তি বাড়ানাে, শারীরিক বলিষ্ঠতা ও সহনশীলতাকে তীক্ষ করা, শরীরের সঠিক ওজন রক্ষা করা তথা শারীরিক ভারসাম্য রক্ষা করা এবং আনন্দ দান করা ইত্যাদি। শরীরচর্চা শরীরের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে গতিশীল করে তােলে। ফলে সকল প্রকার জড়তা থেকে শরীর মুক্ত ও সুস্থ সবল হয়।
শরীরচর্চার প্রয়ােজনীয়তা:
আধুনিক যুগ বিজ্ঞানের যুগ। বিজ্ঞানের নব নব অত্যাধুনিক আবিস্কার মানুষের দৈহিক শ্রমের সুযােগ অনেক কমিয়ে দিয়েছে। ফলে বর্তমান সময়ে শরীরচর্চার প্রয়ােজন অনেক বেশি। কেননা শারীরিক সক্রিয়তা তথা দেহের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সুস্থ ও গতিশীল রাখতে না পারলে পেশিশক্তি একসময় বিপর্যস্ত হয়ে যায়। ফলে জীবনে নেমে আসে দুঃখ-কষ্টের ঘাের অমানিশা । নিয়মিত শরীরচর্চা শারীরিক গতিশীলতা বৃদ্ধি করে এবং রােগের সমৃদ্ধি’ থেকে মুক্ত হতে সহায়তা করে। শরীরচর্চা দেহের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ যেমন— হার্ট, লিভার, কিডনি, অগ্ন্যাশয় ও অন্যান্য এন্ডােক্রাইন গ্রন্থিগুলাে দেহের হরমােন প্রবাহ গতিশীল ও সুষম রেখে রােগ-প্রতিরােধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তােলে। ফলে হৃদরােগ, হাঁপানি, ডায়াবেটিস এবং শারীরিক স্থূলতা প্রভৃতি রােগ থেকে মানুষকে মুক্ত রাখে। এর মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্যেরও উন্নতি সাধন হয় এবং বিমর্ষতা ও দুশ্চিন্তা থেকেও মানুষকে মুক্ত থাকতে সহায়তা করে। বর্তমান বিশ্বে শিশুদের শারীরিক স্থূলতাও একটি বর্ধমান উদ্বেগ । উন্নত দেশে শরীরচর্চার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধানের প্রচেষ্টা চলছে। জীবনে সুষ্ঠুভাবে বেঁচে থাকতে হলে, জীবনকে সাফল্যমণ্ডিত করতে মানুষকে দৈহিক-মানসিক অনেক পরিশ্রম করতে হয়। এ পরিশ্রম কেবল সুস্থ দেহ-মনের অধিকারী মানুষের পক্ষেই সম্ভব। সফল জীবনের অধিকারী হতে হলে রবীন্দ্রনাথ যে প্রয়ােজনের কথা বলেছেন, তা হলাে— “চাই বল, চাই স্বাস্থ্য, আনন্দ-উজ্জ্বল পরমায়ু, সাহস-বিস্তৃত বক্ষপট। ফলে শরীরচর্চার কোনাে বিকল্প নেই। নিজেকে সুস্থ,
সবল করার মধ্য দিয়ে সমাজ ও দেশের উন্নতিকল্পে শরীরচর্চার প্রয়ােজনীয়তা অনস্বীকার্য।
শরীরচর্চার উপায়:
শরীরচর্চার উপায় অবলম্বনে মানবমনের সচেতন প্রয়াস অত্যন্ত জরুরি। কেননা এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে কেবল বাহ্যিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সঞ্চালন নয় বরং অভ্যন্তরীণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গের গতিশীলতাও একান্ত প্রয়ােজনীয়। অর্থাৎ পরিপূর্ণ সুস্থতার জন্যে শরীরের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সক্রিয়তা সমান জরুরি। খেলাধুলা, সাঁতার কাটা, দৌড়, সাইকেল চালানাে ইত্যাদি নানা উপায়ে শরীরচর্চা করা হয়। উপযুক্ত খেলাধুলা শরীরচর্চার প্রাথমিক সােপান, কেননা খেলাধুলার মাধ্যমে শরীরের মাংসপেশিগুলাে হয়ে ওঠে অধিক সুদৃঢ় ও মজবুত। শৈশবকাল থেকেই সকলকে মুক্ত পরিবেশে উপযুক্ত খেলাধুলা ও নানান ধরনের ব্যায়াম অনুশীলনের মাধ্যমে শরীরচর্চার প্রতি আগ্রহী করতে হবে এবং স্বাস্থ্য-সচেতন
করে তুলতে হবে। শরীরচর্চার অন্যতম আরেকটা উপায় হলাে যােগব্যায়াম। দেহের অভ্যন্তরীণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কর্মক্ষমতা গতিশীল করে শরীরকে সুস্থ রেখে কর্মোপযােগী করে তােলার লক্ষ্যে প্রায় ৫ হাজার বছর আগে দ্রাবিড় সাধকরা যােগ-ব্যায়াম উদ্ভাবন করেন। স্বাস্থ্যবিজ্ঞানে যােগব্যায়ামের সাফল্য অনস্বীকার্য। এ যােগব্যায়ামসহ নানা ধরনের খেলাধুলা শরীরচর্চার পক্ষে বিশেষ হিতকর। কিন্তু এক্ষেত্রে লক্ষ রাখতে হবে অনিয়মিত ব্যায়াম শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর। ফলে নিয়মিত। ব্যায়াম এবং পরিমিত ও পর্যাপ্ত খাদ্যগ্রহণের দ্বারাই শরীরকে সুস্থ করে তুলতে হবে।
শরীরচর্চা ও শারীরিক শিক্ষা:
শরীরচর্চাকে প্রকৃত ফলপ্রসূ করতে হলে শারীরিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা একান্ত প্রয়ােজন। পাশ্চাত্যে শরীরচর্চার বিষয়টি শারীরিক শিক্ষার সাথে একীভূত হয়ে গেছে। উন্নত সমাজ, উন্নত জীবনের জন্যেই তারা শারীরিক শিক্ষা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ হয়েছে। সর্বোপরি জাতীয় স্বার্থে তারা শারীরিক শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়েছে। চীন, মিশর, গ্রিস, রােমের প্রাচীন সমাজে শারীরিক শিক্ষা মিলিটারি প্রশিক্ষণের একটা অংশ ছিল। অর্থাৎ সামাজিক ও জাতীয় স্বার্থরক্ষার প্রয়ােজনেই তারা শারীরিক শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিল, পরবর্তীতে উনিশ শতকে শরীর ও স্বাস্থ্যের উন্নতির লক্ষ্যে শারীরিক শিক্ষাকে গুরুত্ব দেয়া হয়।
পাশ্চাত্যে শারীরিক শিক্ষা বিস্তারের যে লিখিত বিবৃতি পাওয়া যায়, তাতে দেখা যায়, ১৫০০ থেকে ১৮০০ খিষ্টাব্দে শারীরিক শিক্ষার বিস্তার ঘটে। এ সচেতনতা নিয়ে যে শারীরিক সুস্থতা তা মনের সুস্থতা দান করে। এ লক্ষ্যে ইউরােপে প্রথম জিমনেসিয়াম স্থাপিত হয় কোপেনহেগেন-এ ১৭৯৯ খ্রিষ্টাব্দে। ১৮১৪ খ্রিষ্টাব্দে Per Ling স্টকহােমে শারীরিক শিক্ষার বিষয়টিকে শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নীত করেন এবং Otto Spiess এক্ষেত্রে অন্য একটি জনপ্রিয় পদ্ধতি প্রণীত করেন জার্মানিতে। এরপর জার্মানি, ডেনমার্ক এবং আমেরিকার পাবলিক স্কুলগুলােতে শারীরিক শিক্ষার বিষয়টি সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯০১ সালে কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে এটা একটা প্রধান বিষয় হিসেবে চালু হয়। সতেরাে শতক থেকে জাপানে শরীরচর্চার বিষয়টি প্রচলিত থাকলেও ১৮৭২ সাল থেকে শারীরিক শিক্ষাকে, আবশ্যিক বিষয়ে পরিণত করা হয়। ১৯১৭ সালের পরে সােভিয়েত রাশিয়ায় এ বিষয়টি স্কুল ও বিশেষ শারীরিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়। বর্তমানে আমাদের দেশেও এ বিষয়টি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষাসূচির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যাতে বিভিন্ন খেলাধুলার নিয়মাবলির পাশাপাশি স্বাস্থ্য-সচেতনতা সম্পর্কেও শিক্ষা দেয়া হয়। তাছাড়া বিভিন্ন জিমনেসিয়াম ও শারীরিক শিক্ষাবিষয়ক আরও কিছু সংগঠনে এবং খেলাধুলাসংক্রান্ত নানা সংগঠনেও এ বিষয়ক শিক্ষা বিস্তৃতি লাভ করেছে।
শরীরচর্চা ও জাতীয় স্বার্থরক্ষা:
যেকোনাে সমাজ, জাতি ও দেশের স্বার্থরক্ষায় সুস্থ, সবল মানুষের বিকল্প নেই। যিনি চিন্তাশীল ব্যক্তি তার যেমন সুস্থতা দরকার। আবার যিনি সামরিক বা প্রতিরক্ষা বাহিনীতে দেশরক্ষার কাজে নিয়ােজিত তাঁরও সুস্থতা দরকার। কেননা সুস্থ দেহের অধিকারী না হলে সুস্থ মনে চিন্তা করা অসম্ভব। আর সুস্থ চিন্তা ছাড়া দেশের সংস্কৃতির উন্নতি সাধনও অসম্ভব। অন্যদিকে, দক্ষ ও শক্তিমান সামরিক শক্তি ছাড়া শত্রু মােকাবিলাও সম্ভব নয়। দুর্বল ও রুগ্ণ জাতি কখনাে শত্রুর কবল থেকে নিজের অধিকার ছিনিয়ে আনতে পারবে না। তাই দেশ ও জাতির অধিকার রক্ষার জন্যে দক্ষ ও সুস্থ-সবল জনশক্তি দরকার, যা নিয়মিত শরীরচর্চার মাধ্যমেই সম্ভব। কেননা শারীরিক দক্ষতাই সামরিক শক্তি, উৎপাদনক্ষমতা এবং জাতীয়তাকে নিশ্চয়তা দান করতে পারে। তাছাড়া খেলাধুলার মাধ্যমে জাতি অর্জন করে আন্তর্জাতিক
খ্যাতি, যা শরীরচর্চারই একটা উপায় ।
উপসংহার:
সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকে দৈহিক শক্তি বৃদ্ধির জন্যে শরীরচর্চার সূত্রপাত হয়। কেননা যেকোনাে সৃষ্টির পেছনে যে অক্লান্ত পরিশ্রম দরকার তার জন্য শারীরিক দক্ষতা সর্বাগ্রে বিবেচ্য। তাই সভ্যতার গােড়াপত্তনের সাথে সাথেই শরীরচর্চার প্রয়ােজন উপলব্ধ হয়। আমাদের দেশ দারিদ্র্যনির্ভর দেশ। দারিদ্র্যের কশাঘাত থেকে মুক্ত করতে হলে প্রয়ােজন উৎপাদনমুখী ব্যাপক পরিকল্পনা আর এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্যে প্রয়ােজন দক্ষ ও কর্মক্ষম জনশক্তি । আর শরীরচর্চার মাধ্যমেই গড়ে উঠবে সেই জনশক্তি। তাই জীবনকে সুন্দর ও সার্থক করে তুলতে হলে নিয়মিত শরীরচর্চার প্রতি মনােযােগী হতে হবে।
উৎসব ও বিনােদন