Table of Contents
বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা রচনার সংকেত
- ভূমিকা
- প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব
- বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন
- বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নে গৃহীত পদক্ষেপ ও উদ্যোগ
- বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নে বাধা
- সর্বজনীন শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নের উপায়
- উপসংহার
বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা রচনা
ভূমিকা:
শিক্ষা অমূল্য সম্পদ। ব্যক্তিজীবন, জাতীয় জীবন এবং অন্যান্য যেকোনাে ক্ষেত্রে শিক্ষার প্রভাব অতুলনীয়। শিক্ষার মানদণ্ডেই একটি জাতির মান নির্ধারণ করা হয়। স্বাধীন দেশে জাতীয় অগ্রগতি ও আর্থসামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে চাই সবার জন্য শিক্ষা। অশিক্ষিত ও অনগ্রসর জাতি যেকোনাে দেশের উন্নয়নের প্রধান অন্তরায়। তাই শিক্ষিত, মর্যাদাসম্পন্ন,আত্মনির্ভরশীল জাতি গঠনের লক্ষ্যে প্রথম ও প্রধান পদক্ষেপ হচ্ছে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম বা সবার জন্য শিক্ষা
কর্মসূচির সফল বাস্তবায়ন। কেননা শিক্ষিত জাতির বিকাশ-চিতই দেশ বা জাতিকে নানামুখী বিকাশে সহায়তা করে বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ডায়ােগনসিসের মতে প্রত্যেক রাষ্ট্রের ভিত হলাে সে দেশের শিক্ষিত যুবসমাজ।
প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব:
কোনাে দেশের জনগণকে মানবসম্পদে পরিণত করতে হলে চাই উপযুক্ত শিক্ষা। প্রাথমিক শিক্ষা হলাে সে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর বা নিম্নতম সােপান। জাতিকে ক্ষুদ্রতা, সংকীর্ণতা, অশিক্ষা, পশ্চাৎপদতা, দারিদ্র্য ও অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতির হাত থেকে মুক্ত করতে হলে চাই সবার জন্য শিক্ষা। শিক্ষাই পারে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুখী-সমৃদ্ধ জীবনের নিশ্চয়তা বিধান করতে শিক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন করে শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক আবুল ফজল বলেছেন –’শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতির শিক্ষিত জনশক্তি তৈরির কারখানা আর রাষ্ট্র ও সমাজ দেহের সব চাহিদার সরাহ কেন্দ্র। এখানে তুটি ঘটলে দুর্বল আর পশু না করে ছাড়বে না।‘ দেশের প্রত্যেকের পক্ষে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করা সম্ভব নয়। তাই সমগ্র জনগােষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষার আলাে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ শিক্ষার মাধ্যমে শিশুর সৃজনীশক্তির বিকাশ ঘটে। তাদের দৈহিক, মানসিক, নৈতিক চরিত্র বিকশিত হয় এবং ব্যক্তিত্বের উন্নয়ন ঘটে। সুতরাং, দেশ ও জাতির সার্বিক উন্নয়নের জন্য বাধ্যতামূলক প্রাথমিক
শিক্ষা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বিখ্যাত রুশ সাহিত্যিক লয় শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে বলেছেন,
‘মানুষকে সভ্য করে তােলার
একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে বিদ্যালয় ।’
বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন:
দেশ ও জাতির কল্যাণের স্বার্থে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে অনেক আগে থেকেই। ১৮৪৫ সালে ‘উডস এডুকেশন ডেসপাচ থেকে শুরু করে ১৮৮২ সালের ইন্ডিয়ান এডুকেশন কমিশন, ১৯১৭-২৭ কালপর্বের বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন, ১৯৪৪ সালের ‘সার্জেন্ট রিপাের্ট ইত্যাদির প্রেক্ষাপটে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নের প্রস্তাব ও উদ্যোগ সত্ত্বেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। স্বাধীন বাংলাদেশে এ ব্যাপারটির ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরােপ করা হয়। ১৯৭৪ সালে কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপাের্টে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয় । ১৯৯০ সালে জাতীয় সংসদে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন পাস হয়। পাঁচ থেকে দশ বছর বয়সি ছেলে-মেয়েদেরকে স্কুলগামী করাই এ আইনের লক্ষ্য। ১৯৯২ সালে উক্ত আইনের আওতায় ৬৮টি থানায় বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা হয়। ১৯৯৩ সাল থেকে ব্যাপকভাবে সারাদেশে এ কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিভাগ নামে একটি স্বতন্ত্র। বিভাগ সৃষ্টি করে প্রাথমিক শিক্ষা ও গণশিক্ষার যাবতীয় কার্যক্রম সম্পাদিত হচ্ছে। ১৯৯১ সালে শিশুভর্তির সংখ্যা যেখানে ছিল ১,২৬,৩৫,০০০ সেখানে বর্তমানে ভর্তির হার প্রায় ১০০% এবং প্রাথমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ না করে ঝরে পড়ার হার ৩০%।
বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নে গৃহীত পদক্ষেপ ও উদ্যোগ:
বর্তমানে বাংলাদেশ প্রকার নিরক্ষরতার অন্ধকার থেকে জাতিকে মুক্ত করতে নানান কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। শিক্ষাপদ্ধতিতে আনা হয়েছে অবকাঠামােগত পরিবর্তন। স্যাটেলাইট স্কুল ও কমিউনিটি স্কুল প্রতিষ্ঠায় সমর্থন দিয়ে শিশুভর্তির সুযােগ বাড়ানাে হয়েছে। চালু আছে প্রায় ১লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়। প্রাথমিক শিক্ষার শিক্ষাক্রমের উন্নয়ন সাধন করে স্বাস্থ্য, পুষ্টি, জনসংখ্যা, পরিবেশ, স্যানিটেশন ইত্যাদি অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে শিক্ষাক্রমকে জীবনভিত্তিক করা হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা ভালােভাবে সম্পন্ন করার উদ্দেশ্যে বিনামূল্যে লেখাপড়ার সুযােগ প্রদান, বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক প্রদান, শিক্ষার জন্য খাদ্য কর্মসূচি প্রবর্তন, বৃত্তি, উপবৃত্তি ইত্যাদি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। সরকারের এ উদ্যোগ প্রশংসনীয়
বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নে বাধা:
যেকোনাে কার্যক্রমের সুফল তা বাস্তবায়নের ওপর নির্ভরশীল। আমাদের দেশে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নানাবিধ সমস্যা পরিলক্ষিত হয়। প্রধান প্রধান সমস্যাগুলাের মধ্যে
উল্লেখযােগ্য হলাে—
১. আমাদের দেশে জনসংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এ অতিরিক্ত জনসংখ্যা তথা শিশুকে স্থান দেয়ার মতাে পর্যাপ্তবিদ্যালয়ের অভাব।
২. চরম দারিদ্র্যসীমায় আমাদের অধিকাংশ লােকের বাস। ফলে আর্থিক সামর্থ্যের অভাবে অনেক পিতামাতা সন্তানকে স্কুলে না পাঠিয়ে উপার্জনের উদ্দেশ্যে কাজে পাঠানােই শ্রেয় মনে করেন।
৩.অশিক্ষিত ও ধর্মীয় কুসংস্কারাচ্ছন্ন অনেক অভিভাবক মনে করেন, সন্তান শিক্ষিত হলে অধার্মিক হয়ে যাবে এবং মাতা-পিতাকে অসম্মান করবে ।
৪. প্রাথমিক পর্যায়ের পাঠক্রম বহুলাংশে গ্রামালের নিম্নবর্গের জনগণের জীবন ও জীবিকার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ও জীবনমুখী নয়।
৫. প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকই শিশুদের মন ও মনন অনুযায়ী পাঠদানে ব্যর্থ । ফলে শিশুরা স্কুলের তথা শিক্ষার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
৬. প্রয়ােজনীয় শিক্ষকের অভাব। তাছাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের অভাব প্রাথমিক শিক্ষার অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে।
সর্বজনীন শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নের উপায়:
সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন নির্ভর করছে সরকার, শিক্ষা প্রশাসন, শিক্ষক সম্প্রদায়, অভিভাবক, সর্বোপরি দেশের আপামর জনসাধারণের সম্মিলিত ও সমন্বিত প্রচেষ্টার ওপর। কেননা জনগণের সম্পৃক্ততা না থাকলে যেকোনাে পদক্ষেপই ব্যর্থ হতে বাধ্য। এক্ষেত্রে সফল বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গৃহীত পদক্ষেপের
উল্লেখযােগ্য কয়েকটি হলাে—
১. প্রয়ােজনীয় সংখ্যক প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন এবং পাঠদানের জন্য প্রয়ােজনীয় শিক্ষকের ব্যবস্থা করতে হবে।
২. গ্রামের অশিক্ষিত পিতামাতাকে শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে বােঝাতে হবে। যাতে তারা ছেলেমেয়েকে স্কুলে পাঠায়।
৩. দারিদ্র্যপীড়িত পরিবারের সন্তানদের জন্য খাদ্যের বিনিময়ে শিক্ষা কর্মসূচির যথাযথ বাস্তবায়ন এবং এক্ষেত্রে যেকোনাে ধরনের দুর্নীতি দমন করতে হবে।
৪. প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিশুদের পাঠদানের জন্য উপযােগী করতে হবে।
৫. পাঠক্রমে এমন বিষয় সংযােজিত করতে হবে যাতে শিশুরা পড়ার সাথে সাথে আনন্দ পায় ।
৬. বিনামূল্যে শিক্ষার উপযােগী উপকরণ বিতরণ করতে হবে।
উপসংহার:
যেকোনাে ব্যাপক কর্মসূচি বাস্তবায়ন সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। এজন্য চাই জাতীয় উদ্যোগ, প্রাণবন্ত নিরলস উদ্দীপনাময় ভূমিকা। সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা প্রসারেও আমাদেরকে নিতে হবে জাতীয় উদ্যোগ। দেশের সার্বিক উন্নয়ন এবং গণতন্ত্রের সুসংহতি দানের জন্য সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারের বাধাগুলােকে খুঁজে বের করে দৃঢ়তার সাথে মােকাবিলা করতে হবে। সকলের সম্মিলিত দৃঢ় প্রচেষ্টা এ কর্মসূচি বাস্তবায়নে শতভাগ সাফল্য আনবেই। তাই দেশের ও জাতির উন্নতি ও অগ্রগতির জন্য দল-মত নির্বিশেষে সবাইকে শিক্ষা বিস্তারে এগিয়ে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে লি. জে. বেইলি’র উক্তিটি
‘শিক্ষিত জাতিই নিখুঁত গণতন্ত্রের সুন্দর লজ্জামুক্ত জিনিস উপহার দিতে পারে।‘