Faria Hasan / December 29, 2020
Table of Contents
গ্রীষ্মের রিক্ততাকে ঐশ্বর্যের পূর্ণতায় ভরে দিতে সাড়ম্বরে-গুরুগম্ভীর রূপে বাংলাদেশে আসে বর্ষা। রােদে পুড়ে যাওয়া। ধরণীকে শীতল, শ্যামল করে দিতে বর্ষা আসে রিমঝিম রবে । বর্ষার ধারা বর্ষণে খালবিল, নদীনালা পায় নবজীবন। কবি।bআবেগে উদ্বেল হয়ে রচনা করেন।
‘এসেছে বরষা, এসেছে নবীন বরষা,
গগন ভরিয়া এসেছে ভুবন-ভরশা।
দুলিছে পবন সনসন বনবীথিকা,
গীতময় তরুলতিকা।
ঋতুচক্রে গ্রীষ্মের এই বর্ষা আসে ধারাবাহিক রুটিন মেনে। গ্রীষ্ম যখন তার প্রবল তাপে প্রকৃতিতে নিজের শক্তির পরিচয়কে প্রতিষ্ঠা করে তখনই বর্ষা এসে গ্রীষ্মের প্রতাপকে চূর্ণ করে দেয়। বর্ষার প্রবল বর্ষণ স্নিগ্ধ করে বাংলার প্রকৃতিকে। মেঘে মেঘে বিদ্যুতের চমক, গুরুগুরু শব্দে গর্জন করা আকাশ, এখানে সেখানে দুত বেগে ছুটন্ত মেঘ— সব মিলিয়ে বর্ষা বাংলার রূপকে বদলে দেয় মুহূর্তেই ।
বর্ষায় বাংলাদেশের প্রকৃতি-পরিবেশ যায় বদলে । পল্লিজীবন ও নাগরিক জীবনে দেখা দেয় বৈচিত্র্য। বর্ষার দিনে কৃষান-কৃষানির কাজে আসে নতুনত্ব। গ্রামের কৃষকরা দাওয়ায় বসে তামাক টানে, কেউ বসে বাঁশের তৈজসপত্র তৈরি করে আর চলতে থাকে আমীর সাধুর কেচ্ছা। কৃষানিদের হাতে সুঁই আর সুতা। তারা নকশিকাঁথা সেলাই আর সমুদ্রকলি শিকা বানাতে বানাতে গুণ গুণ করে মনের আনন্দে গেয়ে চলে গীত। ঘরের বাইরের দৃশ্যও হয়ে ওঠে নানা সাজের। ফুলে ফুলে সজ্জিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কদম গাছ। এছাড়াও ফোটে হাসনাহেনা, বেলি, গন্ধরাজ, জুই, কামিনীসহ অনেক ধরনের ফুল। নদীতে নানা রঙের পালতােলা নৌকা ভেসে যায় দূর-দূরান্তে। গ্রাম্যবধূ নাইওরি হয়ে যায় বাপের বাড়ি। বিল-ঝিলের জলে মৃদু ঢেউয়ে কাঁপতে থাকে শাপলা ফুল। ছোট ছেলেমেয়েরা বর্ষায় মেতে ওঠে বাঁধভাঙা আনন্দে। কলাগাছ কেটে ভেলা বানায় তারা। ভেলাতে করে ভেসে বেড়ায় জলে। নগরের মানুষ ব্যস্ততাকে বাদ দিয়ে বর্ষার আনন্দকে গ্রহণ করতে পারে না। অবিরাম বর্ষণ তাদের কর্মচ্যুতি ঘটাতে পারে না।
অর্থকরী ফসল পাট উত্তোলনের সময় বর্ষা ঋতু। আউশ ধানও ওঠে এ বর্ষাকালেই। আনারস, পেয়ারা ইত্যাদি ফল ও নানারকম শাকসবজিও বর্ষাকালেরই ফসল।
বর্ষা মানবমনে গভীর প্রভাব ফেলে। আষাঢ়ের মেঘ কবি কালিদাসের কাছে মেঘদূত হয়ে উঠেছিল বর্ষার প্রভাবে। বর্ষা মানবমনের আবেগকে নাড়া দেয়। বর্ষার রিমঝিম ছন্দ-তালে মনের মধ্যে ভাবের সঞ্চার হয়, মনের অজান্তে গীত হয় কবিতা বা গানের চরণ। এমন পরিস্থিতিকে তুলে ধরার জন্যই হয়তাে কবিগুরু তাঁর কবিতায় বলেছিলেন
এমন দিনে তারে বলা যায়।
এমন ঘন ঘাের বরিষায়।
পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত কবি বর্ষাকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন। কবি নয় এমন মানুষকেও বর্ষা দেয় কবিতা রচনার প্রেরণা।
বর্ষার উপকারিতা সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয় ফসলের মাঠে । অবিরাম বর্ষণে নদনদীতে যে জোয়ারের পানি সঞ্চিত হয় সে পানি পলল বয়ে আনে। বর্ষার জলে বয়ে আসা পলল কৃষিজমিকে দেয় উর্বরতা। ফলে উর্বর জমিতে ভালাে ফসল জন্মায়। তাই পললকে বর্ষার দান বলা যেতে পারে। বর্ষা এদেশের ঝিলে আর জলাশয়ে নাব্যতা বৃদ্ধি করে। ফলে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পণ্য সরবরাহ অতি সহজ হয়ে ওঠে। বর্ষার জল শুকিয়ে যাবার সময় সে জলকে ধানখেতে আটকে রেখে সেচের সাশ্রয় এবং অধিক ফলন নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।
বর্ষাকালে অতিবর্ষণ প্লাবনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের দেশে প্রায় প্রতিবছরই যে বন্যা হয় এর অন্যতম কারণও বর্ষার অকৃপণ বর্ষণ । পল্লির পথঘাট অতিবর্ষণে কর্দমাক্ত হয়ে পড়ে। হাঁটা-চলা ও নৈমিত্তিক কাজে গ্রামের কর্দমাক্ত রাস্তা তখন বিরূপ হয়ে ওঠে। শহরাঞলেও সৃষ্টি হয় সাময়িক জলাবদ্ধতা। বন্যা পাকা ফসলকে ডুবিয়ে দিয়ে কৃষকের সর্বনাশ করে। এর প্রভাব পড়ে গােটা দেশের জনজীবনে । হাজার হাজার মানুষ বিধ্বংসী বন্যার কবলে পড়ে সর্বহারা হয়ে পথে বসে। নদী তীরবর্তী অনেক গ্রাম ভাঙনের কারণে বিলীন হয়ে যায়।
বাংলাদেশে বর্ষা আনন্দ ও বেদনা দুই-ই বয়ে আনে। তবুও বেদনাকে ছাপিয়ে বর্ষার আনন্দই মানবমনে সবচেয়ে বেশি স্থান করে নেয়। তাই বিমুগ্ধ কবির বর্ষা বন্দনা
“গগনে গগনে আপনার মনে।
কী খেলা তব।তুমি কত বেশে নিমিষে নিমিষে
নিত্যই নব।’
FILED UNDER : রচনা